অবৈধ ভিওআইপির ভয়াবহ সিন্ডিকেট : বছরে রাজস্ব ক্ষতি সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) কারবার করে একটি ভয়াবহ সিন্ডিকেট আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে উঠেছে। তাদের অবৈধ কারবারে সরকার বছরে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে। এসব টাকা হুন্ডি, ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিটিআরসির অভিযানে চক্রের মাঠপর্যায়ে থাকা কিছু কর্মী গ্রেফতার হলেও মূল গডফাদাররা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। রহস্যজনক কারণে তারা আইনের আওতায় আসছে না। অবৈধ ভিওআইপি কারবারিদের কারণে সরকারের কত রাজস্ব ক্ষতি হয়- এ প্রসঙ্গে বিটিআরসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, অবৈধ ভিওআইপির কারণে সরকারের দৈনিক রাজস্ব ক্ষতি হয় কমপক্ষে সাড়ে ১২ কোটি টাকা। মাসে এর পরিমাণ ৩৭৫ কোটি টাকা। বার্ষিক হিসাবে ৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকার বেশি। ভিওআইপির কারণে উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে মোবাইল ফোন অপারেটরদের আন্তর্জাতিক কল। শারুন-সাহাব সিন্ডিকেটসহ ভিওআইপি কারবারিরা সরকারের প্রভাবশালীদের আশ্রিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না বিটিআরসি। অথচ ভিওআইপি শনাক্ত করার সব আধুনিক সরঞ্জাম বিটিআরসির রয়েছে। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলেই অবৈধ ভিওআইপি বন্ধ ও সরকারের রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব হতো।
নিয়ম অনুযায়ী প্রতি মিনিট ইনকামিং আইএসডি কলে সরকার ৩ সেন্ট হিসেবে রাজস্ব পাবে। ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে সার্ভিস প্রোভাইডারসহ বিভিন্ন তথ্য বলছে, দেশে দৈনিক ১০ কোটি মিনিটের বেশি বৈদেশিক কল রিসিভ হয়। এর প্রায় ৭ কোটি মিনিটই আসছে চোরাপথে বা ভিওআইপির মাধ্যমে। এতে দৈনিক প্রায় ২০ কোটি টাকার বিদেশি কল ভিওআইপির মাধ্যমে চুরি হয়। যা বন্ধ করা গেলে সরকার দৈনিক সাড়ে ১২ কোটি টাকা আর বার্ষিক ৪ হাজার ৫৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব পেত। টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত বিভিন্ন দফতর থেকে পাওয়া নথি ও অনুসন্ধান বলছে, সরকারি মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটর টেলিটক রয়েছে ভিওআইপি কারবারের শীর্ষে। এর আগে বিভিন্ন অভিযানে যত সিম জব্দ হয়েছে তার প্রায় ৮৫ শতাংশই টেলিটকের। সংস্থাটির উচ্চপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে ভয়াবহ এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর ছেলে নাজমুল করিম ওরফে শারুন চৌধুরী। রাজধানীর গুলশানে অফিস খুলে তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন দেশের ভিওআইপি কারবারের বড় একটি অংশ। এ কারবারে তার অন্যতম সহযোগী টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাহাব উদ্দিন। টেলিটকের কর্মকর্তাদের কেউ শারুন-সাহাব সিন্ডিকেটের বাইরে গেলে তাদের চাকরিচ্যুতি এমনকি নির্যাতনের শিকারও হতে হয়। শারুন-সাহাব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বেশ একাধিক অভিযোগ জমা হয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘তাদের বিষয়ে কিছু অভিযোগ পেয়েছি। সেখানে বিবেচনা ও আমলযোগ্য কোনো বিষয়ে টেলিটকের এমডিসহ অন্য কারও বিরুদ্ধে তথ্য থাকলে অবশ্যই বিষয়টি তদন্ত করা হবে।’ মন্ত্রী আরও বলেন, ‘সাধারণত আমি একটি কাগজও ফেলে দিই না। এসব অভিযোগ আমলযোগ্য হলে আমাদের পক্ষ থেকে প্রশাসনিক তদন্ত ও অন্য যেসব করণীয় তা অবশ্যই করা হবে।’
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী এ চক্রের অবৈধ কারবারে সরকারই যে শুধু রাজস্ব হারাচ্ছে তা নয়, লোকসান গুনতে গুনতে বৈধভাবে দেশে ফোন কল প্রবেশের ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভিআইপি কারবারের হোতাদের আইনের আওতায় আনা না গেলে অচিরেই ধ্বংসের মুখে পড়বে টেলিকম খাতের বহু প্রতিষ্ঠান। এতে সরকার যেমন রাজস্ববঞ্চিত হবে তেমনি ব্যবসা বন্ধ করে পথে বসতে হবে বৈধ বহু ব্যবসায়ীকে। জানা গেছে, ১৪ জুন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারকে চিঠি দেন জনৈক নূরুল জিহাদ। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘ভিওআইপি কারবারে শারুন চৌধুরীর সঙ্গে টেলিটকের এমডিই শুধু নন, জড়িত রয়েছেন আরও বহু কর্মকর্তা, যার অনেকেই বিতর্কিত ও সমালোচিত। শারুনের ভিওআইপি কারবার গড়ে উঠেছে সেই বহুল আলোচিত হাওয়া ভবনের সিন্ডিকেট ঘিরে। বিটিসিএলে ক্রয় বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ওএসডি করা হয়েছিল সাহাব উদ্দিনকে। তার বেশুমার দুর্নীতির কারণে বিটিসিএলের টেলিকমিউনেশন নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (বিডি-পি ৫৩) থেকে অর্থ প্রত্যাহার করে নেয় জাপানি দাতাপ্রতিষ্ঠান জাইকা। তখন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন অ্যাডভোকেট তারানা হালিম। ভিওআইপি কারবারে সম্পর্কের সূত্র ধরে সাহাব উদ্দিন ধরনা দেন শারুনের কাছে। শারুনের নানামুখী তদবির ও একান্ত চেষ্টায় দুর্নীতির অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়ে যান সাহাব। পরে শারুনের সহযোগিতায় টেলিটকের বড় একটি প্রকল্পে পরিচালকের (পিডি) পদও বাগিয়ে নেন সাহাব উদ্দিন। এর পর থেকে সাহাব উদ্দিনের প্রত্যক্ষ মদদে ভিওআইপি কারবারের জাল বিস্তৃত করেন শারুন। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ২০১৮ সালে এমডির দায়িত্ব পান সাহাব উদ্দিন। এরপর ভিওআইপি কারবারে শনৈ শনৈ উন্নতি হয় শারুনের। ভিওআইপি কারবারে পাওয়া বিপুল অর্থ আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং এবং হুন্ডির মাধ্যমে যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন শারুন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেলিটকের টাওয়ার ও সিম ব্যবহার করে এবং টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠানটিকে অবৈধ ভিওআইপি কারবারের আখড়ায় পরিণত করে শারুন-সাহাবের সিন্ডিকেট। তারা টেলিটকের বিভিন্ন সেবাও বন্ধ করে দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘টেলিপে’ নামে টেলিটকের ডিজিটাল অ্যাপ ছিল। পল্লী বিদ্যুতের বিল আদায় করা হয় এ অ্যাপের মাধ্যমে। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হচ্ছিল। কিন্তু ১৫ জুন কোনো নোটিস ছাড়াই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অ্যাপটি। এর নেপথ্যে রয়েছেন সাহাব উদ্দিন, টেলিটকের মার্কেটিং বিভাগের জিএম প্রভাস চন্দ্র, আইটি বিভাগের জিএম নুরুল মাবুদের যোগসাজশ। যারা সবাই শারুন সিন্ডিকেটের সদস্য। মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশ-এর কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে টেলিটকের অ্যাপসটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন। তা ছাড়া বর্তমানে টেলিটক গ্রাহকদের এসএমএস পাঠিয়ে পল্লী বিদ্যুতের বিল বিকাশে দেওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে লোভনীয় অফার দেওয়া হচ্ছে। এতে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে টেলিপে ও টেলিটকের রিটেইল পয়েন্ট। টেলিটকের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এমডি সাহাব উদ্দিনের দুর্নীতি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে দফায় দফায় অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার মেলেনি। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক অভিযোগ আমলেই নেওয়া হয়নি। এতে তার বেপরোয়া দুর্নীতির মাত্রা দিনে দিনে বাড়ছেই। এমনকি কেউ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে তার অনুগত চক্রকে দিয়ে ওইসব আলামত সরিয়ে নেওয়া হয় এবং যারা অভিযোগ করেন তাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়।’ তারা আরও বলেন, ‘এমডির কার্যালয়ের সামনে থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। কারণ ওই ফুটেজে এক নারী কর্মকর্তার সঙ্গে এমডির অন্তরঙ্গতার বিষয়টি ধরা পড়ে যায়।’
জানা গেছে, টেলিফোন শিল্প সংস্থা-টেশিসের এমডির সঙ্গে যোগসাজশে অপটিক্যাল মাস্ক কেনায় দুর্নীতির আলামত গোপন করার চেষ্টা চালান সাহাব উদ্দিন। তার এসব তথ্য জানেন এমন কিছু কর্মকর্তাকে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। এমনকি কয়েকজনকে শারুনের গুলশানের অফিসে ডেকে শায়েস্তা করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া টেলিটকে নির্বিঘ্ন দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সাহাব উদ্দিন যাকে নিরাপদ মনে করেন তাকেই কাছে টানেন। তার নিজস্ব বলয়ে বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিনের জামাতা ও টেলিটকের কোম্পানি সচিব তাগরিবুল ইসলামের নামও আছে। এ ছাড়া আরও আছেন তিন জিএম নূরুল মাবুদ, আনোয়ার হোসেন ও প্রভাস চন্দ্র এবং ক্রয় বিভাগের ম্যানেজার রফিক। শারুনের সঙ্গে এই কয়েক কর্মকর্তা ভিওআইপিসহ নানান অনিয়ম-দুর্নীতির বিশাল সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। যার মাধ্যমে দুর্নীতি করছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘টেকনিক্যাল কারণে টেলিপে অ্যাপসটি বন্ধ রাখা হয়েছে। শিগগিরই এটি আবার চালু করা হবে।’ দুর্নীতির কারণে ওএসডি থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাকে সাত মাসের জন্য ওএসডি করা হয়েছিল। তবে এটাকে ঠিক ওএসডি বলা যায় না, আমাকে এমডি অফিসে সংযুক্তি দেওয়া হয়েছিল।’ হুইপপুত্র শারুনের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে ভিওআইপি কারবার নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শারুনের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই।’