যশোরে করোনার আইসিইউ ও এইচডিইউ’র ভেতরের চিকিৎসা নিয়ে অভিযোগ

0

মাসুদ রানা বাবু ॥ যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা কেমন চলছে? এ নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন, নানা অভিযোগ। চিকিৎসক সেবিকারা যথাযথ সেবার দাবি করলেও রোগী ও তাদের স্বজনরা বলছেন ভিন্ন কথা। অযতœ অবহেলায় মারা যাচ্ছেন বেশিরভাগ রোগী। হাসপাতালের আইসিইউ ও এইচডিইউ এ চলছে মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসা। যত অভিযোগ এ দুটি ইউনিট নিয়ে।
যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল করোনা রোগীদের চিকিৎসা চলছে হাসপাতাল ও বেসরকারি সংস্থা সাজেদা ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আখতারুজ্জামানের অনুমতিক্রমে আইসিইউ ও এইচডিইউ এর দায়িত্বপ্রাপ্ত সাজেদা ফাউন্ডেশনের আবাসিক মেডিকেল অফিসার নাফিজউল্লাহ জানান, আগের তিনটি আইসিইউ বেডের সাথে আটটি বেড হাসপাতালের পাশাপাশি তাদের নিজস্ব ইক্যুইপমেন্ট দিয়ে মোট ১১ শয্যার আইসিইউ চালু করা হয়। সাথে রয়েছে ১৫ শয্যার এইচডিইউ। সেখানে তাদের জুনিয়র, সিনিয়র ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার মিলে ১১ জন চিকিৎসা সেবা দেন। আছেন ২৮ জন সেবিকা। প্রতি ১২ ঘণ্টা শিফট করে তারা দায়িত্ব পালন করেন। প্রতি শিফটে ৩ জন চিকিৎসক এবং ৭ জন সেবিকা দায়িত্ব পালন করেন। এর বাইরে তাদের কেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্টসহ অফিস অ্যাডমিন এবং পরিচ্ছন্নতা কর্মী রয়েছেন। এছাড়া যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ও সেবিকা রয়েছেন।
নাফিজউল্লাহ জানান, আইসিইউ এবং এইচডিইউ চালুর দিন ১৭ জুন থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত সেখানে ৭৫ জন রোগী ভর্তি হন। এর মধ্যে মারা গেছেন ২১ জন। চিকিৎসাধীন আছেন ২৫ জন। কিছুটা সুস্থ হয়ে রেড জোনে ফিরে গেছেন ২৯ জন রোগী। এখানে চিকিৎসাধীন রোগীর ওষুধ সরকারিভাবে সরবরাহ করা হয়। তারাও অসচ্ছল রোগীদের ওষুধ সাপ্লাই দিয়ে থাকেন। রোগীর স্বজনরা খাবার সরবরাহ করতে না পারলে তারা সরবরাহ করেন। আইসিইউ’র ১১টি শয্যার মধ্যে ৬টি শয্যায় লাইফ সাপোর্ট মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। তার এমন কথার সাথে রোগী ও স্বজনদের কথার মিল নেই। তাদের অভিযোগ চিকিৎসকরা রোগীর পাশে যান দিনে একবার। সেবিকারা রোগীর পাশে না গিয়ে দূর থেকে ওষুধ সামগ্রী ছুঁড়ে দেন। গভীর রাতে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং অক্সিজেনের স্তর ঠিক থাকে না। রোগী যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকলেও তাৎক্ষণিক কোনো চিকিৎসা বা সেবিকা যান না, রোগী কখন মারা গেছেন সেটিও তারা জানেন না। আবার রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও স্বজনদের জানানো হয় না। অন্য রোগীর মাধ্যমে তারা মৃত্যুর খবর জানতে পারেন। বাইরে থেকে ওষুধ সাপ্লাই দিতে গিয়ে রোগীর স্বজনদের সর্বস্ব হারানোর মত অবস্থা হয়। কোনভাবেই স্বজনদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না চিকিৎসার কথা বলে। রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন বুঝতে পারলে স্বজনদের দেখা করতে দেয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুস্থ হয়ে ফিরে আসা এক ব্যক্তি জানান, দিনে এক দুইবার চিকিৎসকরা রাউন্ড দেন। সেবিকারা দূর থেকে ওষুধ ছুঁড়ে মারেন। রোগী যন্ত্রণায় ছটফট করলেও তাৎক্ষণিক কোনো চিকিৎসক বা সেবিকা ছুটে আসেন না। অনেক সময় রোগী যন্ত্রণায় ছটফট করে মারাও যান। রাতে অনেক সময় অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
১১ জুলাই রাত ৩টায় মারা যাওয়া ৫ বছর বয়সী কামাল উদ্দিন ছিদ্দিকের ছেলে আলী হায়দার রানার অভিযোগ, উপযুক্ত চিকিৎসার অভাব এবং অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে তার পিতার মৃত্যু হয়। ওই দিন রাত দুইটায় অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে ভেতর থেকে চিকিৎসকরা হৈ চৈ শুরু করেন। তারা বলতে থাকেন, এবার অনেক রোগী অক্সিজেন না পেয়ে মারা যাবে। হৈ চৈ করার পর অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। এরপর চিকিৎসকরা বলেন এইচডিইউ শয্যার ওই রোগী মারা গেছেন। অথচ সকাল ৯টায় মৃত্যুর সংবাদটি স্বজনদের জানানো হয়। তিন দিনে তার পিতার ওষুধ বাবদ ৫৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। রোগীদের অভিযোগ, চিকিৎসক ও সেবিকারা যতœসহকারে সেবা দিচ্ছেন না। গভীর রাতে অক্সিজেন প্ল্যান্ট থেকে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। হাসপাতাল থেকে ওষুধ সাপ্লাই দেয়ার কথা থাকলেও অনেকের উচ্চমূল্যে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। একই অভিযোগ মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টায় আইসিইউ শয্যায় মৃত্যুবরণকারী আনিছুর রহমানের স্ত্রী নাছরিন নাহার মেয়ে ওয়ার্ধি ইয়াসমিনের। তারা বলেন, রেডজোন থেকে আইসিইউতে আনার পর মঙ্গলবার সকাল ১টা পর্যন্ত চারদিনে ৪০ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়েছে। রাত ৯টার সময় চিকিৎসকরা বলেন, তাকে লাইফ সাপোর্টে নিতে হবে। আপনার বন্ড স্বাক্ষর দেন। স্বাক্ষর দেয়ার পর রাত ১১টার সময় কোনো এক রোগীর স্বজন কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুরোধে ভেতরে যাওয়ার সুযোগ পান। ফিরে এসে তিনি আনিছুর রহমানের মৃত্যুর খবরটি জানান। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে কর্তৃপক্ষকে জানানোর এক ঘন্টা পর তাদের জানানো হয় আনিছুর রহমান মারা গেছেন।
এ বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আখতারুজ্জামান বলেন, অক্সিজেন প্ল্যান্টের কারিগরি ত্রুটির কারণে একদিন রাতে অক্সিজেন লেভেল ঠিক না থাকায় কয়েকজন রোগীর মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে সমস্যার সমাধান করা হয়।
এছাড়া হাসপাতালে বরাদ্দকৃত টাকা হাতে না পাওয়ার কারণে অনেক ওষুধ, ইনজেকশন রোগীদের সরবরাহ করতে পারছি না। সে কারণে রোগীদের বাড়তি অর্থ ক্ষয় হচ্ছে। বিষয়টি সমাধানের জন্য বা অর্থ প্রাপ্তির লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছি। তিনি সেবিকাদের দায়িত্বে অবহেলা প্রসঙ্গে বলেন, বিভিন্ন সময় রোগীর স্বজনদের অভিযোগ শোনার পর তাদের সতর্ক করা হয়েছে। এমনকি বৈঠক করেও তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। আইসিইউ/এইচডিইউ নিয়ে অভিযোগ প্রসঙ্গে সাজেদা ফাউন্ডেশনের মেডিকেল অফিসার নাফিজউদ্দিন বলেন, এই জাতীয় অভিযোগ তার জানা নেই। এমনকি কোনো তথ্যও তার কাছে নেই।