যশোর সদর উপজেলায় করোনা সংক্রমণ অনিয়ন্ত্রিত

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যশোর জেলায় করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সর্বোচ্চ ঢেউ চলছে সদর উপজেলায়। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে একজন আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে তা ছড়িয়ে পড়ছে পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মাঝেও। এমন সংক্রমিত হার আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। স্বাস্থ্য বিভাগ এ জন্য জনসমাগমকে দায়ী করছে। অপরদিকে আক্রান্তের হার বৃদ্ধিতে চিকিৎসক ও সেবিকার সংকট নিয়ে শংকিত যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক।
গত ২৪ জুন থেকে ৩০ জনু পর্যন্ত সাত দিনের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যশোর জেলায় মোট করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৪৫৯ জন। এর মধ্যে কেবলমাত্র সদর উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ২৫৯ জন। বাকি সাতটি উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ২০০ জন। অর্থাৎ মোট আক্রান্তের অর্ধেকেরও বেশি সদর উপজেলায়। এ উপজেলায় কোনভাবেই সংক্রমণের সংখ্যা কমছে না। একাধিক পরিবার রয়েছে তাদের দুই থেকে চার জন করোনা আক্রান্ত।
দৈনিক লোকসমাজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বিএম আসাদ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। এরপর তার স্ত্রীও আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের শিশু দুই মেয়েকে রেখেছেন আত্মীয়ের বাড়িতে। এছাড়া বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসি নিউজের জেলা প্রতিনিধি সাকিরুল কবির রিটন আক্রান্ত হওয়ার পর তা সংক্রমিত হয়েছে তার স্ত্রী ও ছোট ছেলের শরীরেও। যশোর পোস্ট অফিসপাড়ার আমিনুর রহমান, তার স্ত্রী ও দুই মেয়েও একইভাবে আক্রান্ত হয়েছেন।
বুধবার সকাল থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত গত ২৪ ঘন্টায় যশোরে ৫৩৭জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১৪২জনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। এ সময়ে আক্রান্তদের মধ্যেও সর্বোচ্চ ৫০ জন সদর উপজেলায়। বাকিরা অন্যান্য উপজেলায়।
গত ৯ জুন থেকে গতকালের দেশব্যাপী লকডাউনসহ যশোরে সাত দিন করে তিন দফা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কিন্ত করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ হয়নি। প্রথম দফা বিধি-নিষেধের আওতায় ছিল যশোর পৌরসভা ও অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া পৌরসভা। বন্ধ ছিল বিধি-নিষেধ আরোপের এলাকার শপিংমল ও কিছু সড়ক। চালু ছিল কাঁচাবাজার ও গণপরিবহন। প্রথম দফার এ বিধি-নিষেধে কোনো ফল হয়নি। বরং বেড়েছে করোনা সংক্রমণের হার। তাই প্রথম দফার সাত দিনের মাথায় আরও সাত দিন মেয়াদের দ্বিতীয় দফা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয় এলাকা বাড়িয়ে। অন্তর্ভ্ক্তু হয় প্রথম দফার দুই পৌরসভাসহ আরও দুটি পৌরসভা ঝিকরগাছা ও শার্শা। এরসাথে যোগ হয় সদর উপজেলার চার ইউনিয়ন। এরপর ধাপে ধাপে অন্যান্য পৌরসভাতেও বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। কিন্ত বিধি-নিষেধ থাকলেও গণপরিবহণ বন্ধে কঠোরতা ছিল না। সে কারণে যশোর শহরসহ সদর উপজেলার বাসস্ট্যান্ডগুলো থেকে সড়ক-মহাসড়কে বাসের পরিবর্তে সাধারণ যাত্রী নিয়ে চলাচল করেছে মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, ইজিবাইক ও মোটর ও স্যালোমেশিনচালিত ভ্যান।
অপরদিকে অফিস,আদালত ও ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকায় জেলা সদরে যাতায়াত অব্যাহত ছিল উপজেলার মানুষের। এমনকি আশপাশের জেলা মাগুরা, ঝিনাইদহ ও নড়াইলের মানুষের যাতায়াতও ছিল নিয়মিত। সব মিলিয়ে জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটি তিন দফার ওই বিধি-নিষেধের সফলতা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া জনসচেতনতার চরম অভাব রয়েছে যশোরে। করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো ব্যক্তি পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয় না সাধারণ মানুষের চলাচলে। খোলা থাকা কাঁচাবাজারে প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে একই ধরনের ভিড়। সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো সর্তকতা নেই বাজারে। গতকাল শুরু হওয়া দেশব্যাপী লকডাউনের প্রথম দিনেও সকালে একই অবস্থা ছিল যশোর শহরের কাঁচাবাজার ও মাছবাজারে। দোকানিরাই বলেন, প্রতিদিন এত কী বাজার করা লাগে যশোর শহরের মানুষের!
একই অবস্থা যশোর জেনারেল হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে।
জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির মুখপাত্র যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মো. সায়েমুজ্জামান সম্প্রতি বলেন, সংক্রমণ রোধে এখন একমাত্র উপায় জনসচেতনতা। আমরা যশোর জেলায় কঠোর লকডাউন কার্যকর করে চলেছি। আশা করেছিলাম সংক্রমণের হার কমবে কিন্তু সাধারণ মানুষের অসচেতনতা এবং বেপরোয়া চলাফেরার কারণে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির হ্রাস পায়নি। আমরা আশা করবো যশোরের মানুষ আরও সচেতন হবে। করোনার সংক্রমণ রোধে মানুষ ঘরে থাকবে।
এদিকে যশোর জেনারেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ৮০ শয্যার বিপরীতে বুধবার চিকিৎসাধীন ছিলেন ৯৯ জন। মঙ্গলবার এ সংখ্যা ছিল ৯১ জন। অপরদিকে হাসপাতালের করোনা ইয়েলো জোনে ৪০ শয্যার বিপরীতে বুধবার সকাল পর্যন্ত চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ছিল ৫০। মঙ্গলবার এ সংখ্যা ছিল ৬৮। গতকাল বৃহস্পতিবার এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ১০৩ জন। যাদের অধিকাংশই সদর উপজেলার বাসিন্দা।
প্রতিদিনই হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের রেড ও ইয়েলো জোনে অতিরিক্ত রোগী ভর্তির চাপ রয়েছে বলে জানান জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো.আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, যশোর জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীর চাপ বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে ডাক্তার ও নার্স সংকট রয়েছে।
এদিকে মঙ্গলবার থেকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ছয় হাজার লিটারের হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা অক্সিজেন সিলিন্ডার চালু করা হয়েছে।
এছাড়া করোনার প্রথম ধাপে সরকারি বরাদ্দকৃত ১০টি আইসিইউ বেডের মধ্যে সম্প্রতি তিনটি বেড স্থানীয়ভাবে চালু করা হয়। অতি সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা সাজেদা ফাউন্ডেশন আরও তিনটি বেড আইসিইউর উপকরণ দিয়ে চালু করে। তবে সরকারি ভাবে শুধুমাত্র শয্যাই বরাদ্দ হয়েছে আইসিইউতে। আর কিছু দেওয়া হয়নি। ফলে জেলার একমাত্র আইসিইউটিও পরিপূর্ণ নয়।
যশোর সদর উপজেলায় করোনা সংক্রমণ এমন উদ্বেগজনক হওয়ার বিষয়ে সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন বলেন, এখানে জনসমাগম ও মানুষের চলাচল বেশি। সব ধরনের অফিস-আদালত এখানে। যে কারণে সংক্রমণের মাত্রাটিও বেশি। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে বলা না গেলেও পরবর্তীতে বলতে পারবো কঠোর বিধি-নিষেধে আমরা সফল হয়েছি কিনা ? সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতার কোনো কারণ নেই। আমাদের পরিকল্পনা আছে করোনার জন্যে হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বাড়ানোর। পাশাপাশি বেসরকারি জনতা হসপিটালের ২০টি শয্যা ২৫০ শয্যা হাসপাতালের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।