বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ইউনিভারসাল পেনশন সিস্টেম চালুর দাবি

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদেরকে পেনশন সিস্টেমের আওতায় আনতে দেশে একটি ইউনিভারসাল পেনশন সিস্টেম চালু করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি আসন্ন বাজেটে কর্মসংস্থানের বিষয়টি বেশি জোর দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন একটি ভার্চুয়াল সেমিনারের আলোচকরা। বাংলাদেশ প্রাইভেট ইমপ্লয়েজ ফোরামের (বিপিইএফ) আয়োজনে ‘করোনাকালে বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান: ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। বিপিইএফ আহ্বায়ক রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে ওয়েবিনারটি মডারেট করেন ইউএনবির সিনিয়র সাব-এডিটর মুহাম্মদ আল-আমিন আবির।
সেমিনারে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বেসরকারি চাকরির বিষয়ে আমাদের এখানে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নাই। কয় বছর পরপর একটা সার্ভে হয়। কিন্তু এমপ্লয়মেন্ট কতখানি বাড়ছে এসব কোনো তথ্য নেই। সরকার জিডিপি নিয়েই পড়ে আছে, যা ধরাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না। ২২০০ ডলার মাথাপিছু আয় অথচ আমরা গরিব হচ্ছি। ‘৬০ শতাংশ মানুষ বলছে, তাদের আয় কমছে। আমাদের মাইগ্রেশন হয়। কিন্তু নিট মাইগ্রেশন কত তা আমরা জানি না। কতজন বিদেশ গেল তার হয়ত একটা হিসাব থাকে। তবে কতজন ফিরে আসল তা কিন্তু জানি না। এই যে রেমিট্যান্স গ্রোথ বেড়েছে, কিন্তু কেন বাড়ল আমরা জানি না। কারণ তথ্যের বিশাল ঘাটতি।’ এসএমই খাতে আরও টাকা দিতে হবে। ব্যাংক লোন দিয়ে দেউলিয়া না হয় সরকারকে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। দায়ভার শুধু ব্যাংকের ঘাড়ে রাখা যাবে না’ উল্লেখ করেন তিনি।
করোনায় ৪০-৬০ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক কোটিরও বেশি পরিবার দুরবস্থায় আছে। আমি অর্থমন্ত্রীকেও বলেছি, আবারও বলছি, প্রত্যেক পরিবারকে মাসে দুই হাজার টাকা করে বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকা দিন। ভাল হবে। বিশ্বের অনেক দেশ এটা করছে। ভারত একটা স্কিম নিয়েছে, অনেক দেশ করেছে। ক্যাপিটাল টু লেবার রেশিও বেড়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ অনেক কমে গেছে। কতটা কমেছে তা আমরা জানি না। তবে মেশিনারিজ আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় এটা বোঝা গেছে যে, বিনিয়োগ কমেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। পেনশন ফান্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশে এখনও কোনো পেনশন ফান্ড চালু হয়নি। সরকার সরকারি চাকরিজীবীদের যেটা নিচ্ছে সেটা খরচ করে ফেলছে। কম করে হলেও ২৪-২৫ লাখ কোটি টাকার লায়বেলেটিস সরকারের ঘাড়ে। এই টাকা ফেরত দিতে হবে। এখন থেকে একটা সিস্টেম চালু করলে ৩০ বছর পর একটা ফুল ফান্ড চালু হবে।
দীর্ঘমেয়াদী ফাইন্যান্সিং স্কিম জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের ফিন্যান্সিয়াল স্কিম আছে। কোনো ব্যাংক পদ্মা সেতু বা বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারবে না। কারণ সেগুলো ২০-৩০ বছরের প্রকল্প। পেনশন ফান্ড সৃষ্টি হলে এগুলো দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করা যাবে। সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি ফিন্যান্সিয়াল স্কিম চালু করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের কোভিডের ওপর ফোকাস করেই বাজেট করতে হবে। কোভিড দূর করতে হলে ভ্যাকসিন দিতে হবে। সরকারকে দুটো ওয়েভের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এটা ভারতের মতো হবে কি-না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এজন্য স্বাস্থ্য খাতে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতি করতে হবে। রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টারগেশন ফর ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ বলেন, প্রতি বছর ৩৩ লাখ নতুন শিশু জন্ম নিচ্ছে। এর মধ্যে থেকে ২৩ লাখ লেবার ফোর্স হিসেবে আসছে। কিছু শিশু হয়তো মারা যায়। কিন্তু বাকিরা কর্মক্ষেত্রে আসছে না। যারা আসছে তাদের বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। ‘সরকার করোনাকালে যেসব প্রণোদনা দিয়েছে তা অনেকটা লোন বেইজ। এটাও কতটুকু পেয়েছে তা ফলো করা হয় না। যারা পেল না তারা ঠিক কি কারণে পেল না, তাও জানা যায় না। কারণ কোনো ড্যাসবোর্ড নাই। সরকার যদি কোনো সাহায্য দিতে চায়, তাও পারছে না। কারণ কোনো ডাটাবেজ নেই। এই তথ্যভাণ্ডার না থাকা আমাদের একটি বড় গ্যাপ। করোনা শুরুর এক বছর পরেও যদি আমরা বলি- আমাদের ডাটাবেজ নেই এটা দুঃখজনক। আমাদের তথ্যপ্রাপ্তি অনেক সীমিত।’
পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, গত বছর থেকে প্রায় দুই কোটি ৪৮ লাখ কাজ হারিয়েছি। এরা সবাই বেসরকারি খাতের। এটা মোট কর্ম ঘণ্টার ১৭ শতাংশ। সরকার যদি প্রণোদনা না দিত তাহলে এটা আরও অনেক বেড়ে যেত। করোনার আগেই পোশাক খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি কমে গিয়েছিল। বিআইডিএসের ২০২০ সালের গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৬ লাখ তরুণ-তরুণী কর্মসংস্থান হারিয়েছে। ইউএনডিপি বলেছে, ২৭ লাখ চাকরিজীবী তাদের চাকরি হারিয়েছে। এরা সবাই বেসরকারি খাতের। ‘৩৬ শতাংশ মেশিনারিজ আমদানি কমেছে, ৩৯ শতাংশ বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে। সরকার আগে যে প্রণোদনা দিয়েছিল সেখানে ইমপ্লয়মেন্ট বেনিফিট বলতে কিছু ছিল না। এবারের বাজেটে সরকার এটাকে যুক্ত করতে পারে। সরকারকে আরেকটা প্রণোদনা প্যাকেজ দিতেই হবে, সেটা যে নামেই হোক না কেন।’ ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম বলেন, দেশের মোট চাকরিজীবীর ৯৫ শতাংশই বেসরকারি খাতে কাজ করেন। অথচ তৈরি পোশাক খাত ছাড়া অন্য কোনো খাতে আমরা কাঠামোয় আনতে পারিনি। আমরা যারা গণমাধ্যমে কাজ করি সেখানে অনেকেই ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করে না। অথচ সরকারি বিজ্ঞাপন নিতে হলে ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের চাকরি বিধিমালা নেই, কিন্তু শ্রম আইন আছে। বর্তমানে যেটা সবচেয়ে বেশি জরুরি তা হলো, আমাদের টিকা দিতে হবে। তাহলে কর্মপরিবেশ ফিরে আসবে। পোশাক খাতের মতো অন্য খাতগুলোতেও প্রণোদনা দিতে হবে। আইসিএবি সভাপতি এম এইচ খসরু বলেন, আমাদের কেবল চাকরিজীবী নয়, উদ্যোক্তাও বানাতে হবে। স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। স্বাস্থ্য খাতে আমরা গত বছর যে বরাদ্দ করলাম তার ৩০ শতাংশ খরচ করতে পেরেছে। এটা ব্যয় করতে হবে। ট্যাক্স সহজ করে দিতে হবে যাতে সবাই ট্যাক্স দেয়। বিজিএমইএ সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, করোনায় আমাদের পোশাক খাতে ক্ষতি অনেক হলেও আক্রান্ত হার দশমিক তিন শতাংশ। যদিও করোনার শুরুতে ৬০-৭০ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। তবে পরবর্তীতে তারা আবার কর্মস্থলে বা অন্য কোথাও যোগ দিয়েছেন। এখন আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। ‘আমাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া ছোট কারখানাগুলো চালু করতে পাঁচ মিলিয়ন ডলারের একটা সহায়তা ছিল, সেটাকে ১০ মিলিয়ন করা যেতে পারে। বিশ্বে এখন কৃত্রিম সূতার চাহিদা ৭০ শতাংশ আর কটন ৩০ শতাংশ। কটনের দামও অনেক চড়া। পণ্যের ভ্যালু অ্যাড করতে কৃত্রিম সূতা উৎপাদনে সহায়তা করা যেতে পারে।’ ডিসিসিআই সভাপতি রেজওয়ান রহমান বলেন, অর্থমন্ত্রী একটা প্রস্তাব করেছিলেন ভলান্টিয়ারি পেনশনের। এটার জন্য একটা আইন প্রয়োজন। আইন তো সব জায়গায় আছে। কিন্তু কতটুকু আইনের আওতায় আনা যায় এটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। গার্মেন্টস সেক্টরকে সহায়তা করায় এখন ৫০ বিলিয়ন দেয়ার সক্ষমতা হয়েছে। অন্য খাতগুলোকে বাছাই করে সহায়তা করলে সেখান থেকেও ৫০ বিলিয়ন রফতানি পাওয়া যাবে। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, দেশে ৪৩টি প্রাতিষ্ঠানিক শ্রম খাত আছে। এর মধ্যে ৩২টির কোনো মজুরি বোর্ড গঠিত হচ্ছে না। দেশে পর্যটন খাতে প্রায় পাঁচ লাখ, পরিবহন খাতে ৭০ লাখ, সেলুনে ১২-১৩ লাখ মানুষ কাজ করে। করোনাকালে এরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে। এদের নিয়ে বাজেটে ভাবা দরকার। দেশের সব শ্রম শক্তির নিবন্ধন থাকা প্রয়োজন। দেশে জিডিপি বাড়ছে, সে অনুযায়ী বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ছে কি-না সেটা তো ভাবা প্রয়োজন। বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের বিষয়টি বিবেচনা করে একটি ইউনিভারসাল পেনশন সিস্টেম চালু করা এখন খুবই জরুরি।