‘মরে গেলে মাফ করে দিয়েন’

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥সেহরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন দেলোয়ার হোসেন। হঠাৎ নাকে পোড়াগন্ধ। দরজা খুলে দেখেন সিড়িতে ধোঁয়া ও আগুনের কুণ্ডুলী। দরজা বন্ধ করে পরিবার নিয়ে বের হওয়ার উপায় খুঁজছিলেন। কিন্তু বের হতে পারেনি। স্বজনদের ফোন দিয়ে বাঁচানোর আঁকুতি জানান দেলোয়ার হোসেন। নিরুপায় হয়ে বাঁচার আশাই ছেড়ে দেন একসময়। স্বজনকে ফোনে অনুরোধ করেন, তাদের যেন মাফ করে দেওয়া হয়। মারা গেলে তাদের জন্য কোরআন খতম করারও অনুরোধ করেন দেলোয়ার।
শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) ভোররাতে পুরান ঢাকার আরমানিটোলার যে বাড়িতে আগুনে চারজন নিহত হয়েছেন সেই বাড়ির ষষ্ঠ তলায় পরিবার নিয়ে আটকা পড়েছিলেন দেলোয়ার হোসেন। শুক্রবার দুপুরে তার ভাবী হোসনে আরার সঙ্গে কথা হয় শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে। তিনি জানান, আগুনে দেলোয়ার হোসেন, তাঁর স্ত্রী লায়লা বেগম, দুই ছেলে সাফায়েত হোসেন ও শাকিল হোসেন, সাফায়েতের স্ত্রী মিলি ও তাঁদের মেয়ে ইয়াশফা (২) দগ্ধ হয়েছেন। দুই বছরের ইয়াশফা তার ছোট্ট শরীরে আগুনের ক্ষত নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে। সাফায়েতের অবস্থাও গুরুতর। তিনি আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।
হোসনে আরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘সেহরির সময় দেলোয়ার ফোন দিয়ে কাঁদছিল। আমি ভয় পেয়ে যাই। তাকে প্রশ্ন করলাম কী হয়েছে। বলে বাসায় আগুন লাগছে। আমি বললাম, বের হয়ে আসো। কিন্তু বের হতে পারছিল না। কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছিল না। বারবার বলছিল, আগুনে আটকা পড়েছি। মরে গেলে মাফ করে দিয়েন। কোরআন খতম করাইয়েন।’
এরপর আরমানিটোলার বাসায় ছুটে আসেন তিনি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এই পরিবারের ছয়জনকে উদ্ধার করার পর প্রথমে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
দেলোয়ার হোসেনের আরেক ভাইয়ের পরিবার ভবনটির পঞ্চম তলায় থাকতেন। সেই পরিবারটিও দগ্ধ হয়েছে। তারা হলেন- খোরশেদ আলম (৫০) তার স্ত্রী চেশমেয়ারা বেগম (৪৫) ও ছেলে সাখাওয়াত হোসেন (২৭)। তারাও শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছেন।
একমেয়ে নিহত, অপর মেয়ে স্বামীসহ আইসিইউতে
ইব্রাহীম সরকার (৬০) পুরান ঢাকার চাল ব্যবসায়ী। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তার ছোটমেয়ে সুমাইয়া সরকার মারা গেছেন। সুমাইয়া ইডেন কলেজে ইংরেজি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। আইসিউইতে রয়েছে বড় মেয়ে ইসরাত জাহান মুনা সরকার ও (২৬) তার স্বামী আশিকুজ্জামান (২৮)। দুইমাস আগে তাদের বিয়ে হয়।
আশিকুজ্জামান থাকতেন তার মিরপুরের খালার বাসায়। বৃহস্পতিবার রাতে পুরান ঢাকায় শ্বশুরের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। এই নবদম্পতি এখন আইসিইউতে। তাদের শরীরের ২৫ শতাংশেরও বেশি দগ্ধ হয়েছে। এ ছাড়াও দগ্ধ হয়েছেন ইব্রাহীম সরকারের স্ত্রী সুফিয়া বেগম (৫০) ও ছেলে জুনায়েদ সরকার (২০)।
স্ত্রী-সন্তানসহ দগ্ধ ইউনুস মোল্লা
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা চলছে চাল ব্যবসায়ী ইউনুস মোল্লা (৫৫) এবং তার পরিবারের চারজনের। ভবনটির তৃতীয় তলায় থাকতেন তারা। অগ্নিকাণ্ডে ইউনুস মোল্লা ছাড়াও দগ্ধ হয়েছেন তার স্ত্রী মেহেরুন্নেসা (৪০), মেয়ে ফাবিহা ও ছেলে আকাশ।
আরও যারা দগ্ধ
দগ্ধের তালিকায় আছেন ভবনের বাসিন্দা আকাশ (২২), আসমা সিদ্দিক (৪৫), মেহেরুন্নেছা (৫০) পাবিহা (২৬), উনশি মোল্লা (৪০) ও মো. ফারুক হোসেন (৫৫)। তাদেরকেও ভর্তি রাখা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের চার কর্মী আহত
এই ঘটনায় উদ্ধারকাজ চালাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের চার কর্মী আহত হয়েছেন। তারা হলেন গিয়াসউদ্দিন, বিসুপদ মিস্ত্রি, লিটন, ফরহাদ রহমান।
আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন
দুই সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে রেহানা থাকতেন আরমানিটোলার ৯/১১ হাজী মুসা ম্যানসনে। তিনি বলেন, ‘দুই সন্তান আল্লার রহমতে সুস্থ আছে। স্বামী হাসপাতালে ভর্তি। কিভাবে বেঁচে আসছি আল্লাহ জানেন। এটুকু বলেই কাঁদতে থাকেন।
আগুনের খুব কাছ থেকে বেঁচে ফিরেছেন জেসমিন আক্তার ও তার পরিবার। ভবনটির দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে ছিলেন তারা। ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে জেসমিন আক্তার বলেন, ‘জীবন নিয়ে ফিরে আসবো ভাবিনি। নতুন জীবন পেয়েছি। আমার সন্তানরাও এতিম হয়নি।’
রাসায়নিক দ্রব্য সরিয়েছে সিটি করপোরেশন
শুক্রবার বিকালেই ভবনের সামনে গিয়ে দেখা যায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতে ভবনের দ্বিতীয় তলা ও নিচতলার গুদাম থেকে রাসায়নিক দ্রব্য বের করছেন কিছু শ্রমিক। দুটি বড় পিকাপ ও পাঁচটি ছোট পিকাপে এসব দ্রব্য নিয়ে যায় ডিএসসিসি।
উল্লেখ্য, শুক্রবার ভোররাত ৩টা ১৮ মিনিটে আরমানিয়া স্ট্রিটের হাজী মুসা ম্যানসনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ভবনটির নিচে রাসায়নিকের গুদাম ছিল। ভবনের দোতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত বিভিন্ন পরিবারের বাস।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। দগ্ধ হয়েছেন ২০ জন। সবাই হাসপাতালে ভর্তি। চারজনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।