হরতালে টানটান উত্তেজনা, সংঘর্ষ, গুলি

0

রুদ্র মিজান ও আল আমিন॥ দিনভর সংঘর্ষ। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। যানবাহন ভাঙচুর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে মুহুর্মুহু রাবার বুলেট, টিয়ারগ্যাস ও গুলি নিক্ষেপ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি’র সঙ্গে অ্যাকশনে ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষে পুলিশ ও বিজিবিকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে আন্দোলনকারীরা। গতকাল হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে রণক্ষেত্র ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড, শানারপাড়, কাঁচপুর এলাকা। দিনভর থেমে থেমে চলেছে সংঘর্ষ।
ভাঙচুর করা হয়েছে বিভিন্ন যানবাহন। ওই সড়কে উল্লেখযোগ্য কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেয়নি হরতাল সমর্থকরা। সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অর্ধশত। এরমধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অন্তত পাঁচজন। তাদের মধ্যে তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রাণহানির ঘটনার প্রতিবাদে হেফাজতের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতালে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছিল টানটান উত্তেজনা। বিভিন্ন জায়গায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলির ঘটনা ঘটে। রাজধানীর পল্টনে কয়েক দফা সমাবেশ করে হেফাজত। এ ছাড়া আরো কয়েকটি স্থানে তারা বিক্ষোভ করে। তবে রাজধানীতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। যানবাহন চলাচল ছিল তুলনামূলক কম। হরতালের বিরুদ্ধে রাজধানীতে দিনভর মিছিল সমাবেশ করেছেন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।
সরজমিন দেখা গেছে, হরতালের সমর্থনে সকাল থেকেই মিছিল নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাক, ডেমরা, কাঁচপুর, সাইনবোর্ড এলাকায় অবস্থান নেয় বিভিন্ন বয়সের মানুষ। তারা শিমরাইল ইউটার্ন এলাকায় লাঠিসোটা নিয়ে অবস্থান নেয়। সকালে হেফাজতের নেতাকর্মীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন। তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহসড়কের সাইনবোর্ডসহ কয়েক স্থানে গাছের গুঁড়ি, বিদ্যুতের ঢালাই পোল (খুঁটি) ফেলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। টায়ার, কাঠ-বাঁশে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে তারা। এ সময় হরতালের সমর্থনে ও সরকার এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন। এ সময় বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন প্রকার যানবাহন ভাঙচুর করে হরতাল সমর্থকরা। আতঙ্কে ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শুরুতে হরতাল সমর্থকদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দিতে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা হামলা চালালে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে পিছু হটে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। একপর্যায়ে সকাল সাড়ে ১০টায় হরতাল সমর্থকদের ওপর রাবার বুলেট ছুড়ে বিজিবি ও পুলিশ। এ সময় বিজিবি ও পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ে হরতাল সমর্থকরা। সেইসঙ্গে একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সংঘর্ষে তিনজন হরতাল সমর্থক গুলিবিদ্ধ হন। এরমধ্যে ৩৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ শাকিল নামে এক কাঠমিস্ত্রি ও ষাট বছর বয়সী শফিকুল ইসলাম এবং বারিক নামে একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। তারা পথচারী বলে জানা গেছে। সংঘর্ষের শিকার হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধাওয়ার শিকার হয়ে হেফাজত কর্মীরা বিভিন্ন গলিতে আশ্রয় নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শানারপাড় এলাকায় ফের অবস্থান নেয় তারা। অন্যদিকে কয়েকশ’ মিটার দূরে সাইনবোর্ড এলাকায় অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। এ সময় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে হরতালবিরোধী মিছিল করে। মিছিলের আলোকচিত্র ধারণকালে মানবজমিনের প্রধান আলোকচিত্রী শাহীন কাওসারসহ আরো কয়েকজন ফটো সাংবাদিকের ক্যামেরা ভাঙচুর করে তারা। এ সময় থেমে থেমে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও হরতাল সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিলো। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে জিটিভি’র ক্যামেরা পার্সনের ওপর হামলা চালায় হরতাল সমর্থনকারীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে বেলা পৌনে ২টায় পুলিশ ও বিজিবি’র যৌথ অভিযানে সাইনবোর্ডের মূল সড়ক থেকে পিছু হটে হেফাজত কর্মীরা। এ সময় রাবার বুলেট, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করা হয়। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে হেফাজত কর্মীদের ধাওয়া করে। এই অভিযানে বিজিবি ও পুলিশের ৫-৭টি সাঁজোয়া যানও অংশ নেয়। সংঘর্ষে হরতাল সমর্থক কয়েকজন আহত হন। দুটি এম্বুলেন্সযোগে তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এর কিছুক্ষণ পর স্লোগান দিতে দিতে আবারো মূল সড়কে অবস্থান নেয় হরতাল সমর্থনকারীরা। এ সময় পুলিশকে সংঘর্ষে জড়াতে চিৎকার করে আহ্বান জানায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। ওই সময়ে নিউজ টোয়েন্টিফোর’র একটি গাড়ি ভাঙচুর করে তারা। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ওই এলাকায়। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে মানবজমিনকে বলেন, কাঁচপুর সাইনবোর্ড এলাকায় সকাল থেকে হরতাল সমর্থনকারীরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে। আমরা বারবার তাদের সরিয়ে দিয়েছি। তারা দিনভর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। সন্ধ্যার পর তারা চলে গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সন্ধ্যায় হরতাল শেষ হয়ে গেলেও সেখানে বেশ কয়েকটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পল্টনে সমাবেশ, বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ: ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় পুলিশের গুলিতে হেফাজতের নেতাকর্মী নিহতের প্রতিবাদে দলটির ডাকা হরতালের সমর্থনে পল্টন মোড়, মোহাম্মদপুর, কুড়িল বিশ্বরোড ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে হেফাজতের নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। এ সময় তাদের হরতালের সমর্থনে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়। তারা সেখান থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি পল্টন মোড়ে আসলে পুলিশ বাধা প্রদান করে। এ সময় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এবং এর আশপাশে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের দেখে তারা ধাওয়া দেয়। তখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও তাদের পাল্টা ধাওয়া দেয়। উভয়পক্ষই ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে ওই এলাকার পরিবেশ থমথমে হয়ে ওঠে। আশপাশে থাকা লোকজন আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকেন। তবে সেখানে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পরে পুলিশ দুই পক্ষকে হটিয়ে মাঝে অবস্থান নেয়। হরতালে ওই এলাকায় যানবাহনের সংখ্যা চলাচল কম দেখা গেছে। পুলিশ পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা, ও নাইটিংগেল মোড়ে ব্যারিকেড দেয়। পরে হেফাজতের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, আজ হেফাজতের হরতাল কর্মসূচি ছিল, আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচি ছিল না। তবুও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মাঠে দেখা গেছে আওয়ামী পাণ্ডাদের। আমার শান্তিপ্রিয় ভাইদের ওপর পুলিশ-বিজিবি নির্বিচারে গুলি ছুড়েছে। এভাবে গুলি করে হেফাজতকে দমানো যাবে না, বরং সরকার তার গদি টেকাতে পারবে না।
মামুনুল হক আরো বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছি। রক্ত ঝরিয়ে রাজপথ থেকে হেফাজত কর্মীদের সরানো যাবে না। আবার যদি আমার কোনো ভাইয়ের রক্ত ঝরে, হত্যা করা হয়, আর একটি গুলিও যদি ছোড়া হয়, তাহলে গোটা দেশকে অচল করে দেয়া হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি আরো বলেন, তারা ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন। এটাকে দুর্বলতা ভাবলে ভুল করবে সরকার। বন্দুকের নল ও সন্ত্রাস দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না। তিনি নেতাকর্মীদের বিশৃঙ্খলা না করা এবং বহিরাগতদের ফাঁদে পা না দিয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানান। এদিকে, দুপুর পৌনে ২টার দিকে হেফাজতে ইসলামের হরতালে সমর্থন দেয়া চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতাকর্মীরা বায়তুল মোকাররমে একটি সমাবেশ করেন। সমাবেশে বক্তব্য প্রদান করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম বলেন, কেউ কেউ মনে করছেন দেশটা নিজের পৈতৃক সম্পত্তি। এটা ভাবলে ভুল হবে। এ দেশ সবার। ভারতের কসাই মোদি দেশে আসার কারণে আমার দেশের মুসলমানের রক্ত ঝরলো। এ রক্তের হিসাব সরকারকে দিতে হবে। যদি তারা হিসাব দিতে না পারেন তাহলে আমরা রাস্তা ছাড়বো না। দুর্বার গণআন্দোলন করে এ ভারতের পদলেহি সরকারকে বিদায় করা হবে। সমাবেশের পরে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা একটি মিছিল বের করেন। মিছিলটি পল্টন মোড়ে গেলে তা পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয়। সেখানে নেতাকর্মীরা বিকল্প পরিবহনের একটি বাসের গ্লাস ভাঙচুর করে। পুলিশের হস্তক্ষেপে সেখানকার পরিস্থিতি শান্ত হয়। এদিকে, সকাল ১১টার দিকে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। এ সময় সেখানে আগে থেকে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ছাড়াও হেফাজতের নেতাকর্মীরা গতকাল সকাল ১১টার দিকে বসিলা ব্রিজের কাছে সড়ক অবরোধ করে। এতে সেখানে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলে তারা সেখান থেকে চলে যায়। পরে পুলিশ সেখানে যান চলাচল উন্মুক্ত করে দেয়। এ ছাড়াও দুপুর ১২টার দিকে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় হেফাজতের নেতাকর্মীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এতে উত্তরার আশপাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এদিকে, গতকাল দুপুরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি ব্লকে অবস্থিত ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার থেকে ২০০-৩০০ হেফাজতকর্মী বের হয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিলটি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় প্রদক্ষিণ শেষে প্রধান গেট দিয়ে বের হয়ে প্রগতি সরণিতে যায়। এ সময় পুলিশ রাস্তা অবরোধ করতে বাধা দেয়। এ নিয়ে পুলিশ ও হেফাজতকর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। প্রায় এক ঘণ্টা পর পুলিশ মৃদু লাঠিচার্জ করে হেফাজতকর্মীদের সরিয়ে দেয়। ভাটারা থানার ওসি মোক্তারুজ্জামান বলেন, তারা রাস্তা অবরোধ করেছিল। পরে তাদেরকে বুঝিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।