মোদির সফরের আগে তিস্তা নিয়ে কি শোনাচ্ছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী?

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ‘দশ বছর আগে তিস্তা চুক্তি সই হয়েছে’ মর্মে দু’দিন আগে দেয়া নিজের বক্তব্যে অনড় থাকলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫ রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের অত্যাসন্ন বাংলাদেশ সফর বিষয়ে অবহিত করতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিস্তা সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী মোমেন গতকালও বলেন, হ্যাঁ, তিস্তা অলরেডি ১০ বছর আগেই চুক্তি হয়ে গেছে, বাস্তবায়ন হয়নি। কেন বাস্তবায়ন হয়নি- তা ভারত সরকারই ভালো বলতে পারবে। তিস্তা চুক্তির দলিলের প্রতিটি পাতায় উভয় দেশের সচিবের সই রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে সচিব পর্যায়ে চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়ে থাকলে এতোদিন তা চাপা ছিল কেন? তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ‘তিস্তা চুক্তিতে কোনো ছাড় নেই’ বলার পরপরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন ‘সই হয়ে আছে’ বলে প্রচারে নামলেন? জবাব খুঁজতে সরকারের সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে গতকাল গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু দায়িত্বশীল কেউই মন্ত্রীর দাবির বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে তারা এটা নিশ্চিত করেছেন যে, যাই বলুক না কেন, তিস্তা চুক্তিটি এখনো সই হওয়ার অবস্থায় যায়নি। তা খসড়াতেই আটকে আছে।
সদ্য ঢাকা সফরকারী ভারতের বিদেশমন্ত্রী ড. সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্করকে উদ্ধৃত করে কর্মকর্তারা বলেন, তিনিও তো বলে গেছেন দ্রুত তিস্তা চুক্তি সইয়ে ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের অঙ্গীকারে কোনো হেরফের হয়নি। হাসিনা-মোদি আমলেই তিস্তা সই হবে বলে খোদ দেশটির প্রধানমন্ত্রী আগের বারের বাংলাদেশে সফরকালে আশ্বাস দিয়ে গেছেন। ঢাকার কর্মকর্তারা এ-ও জানান, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ২৬শে মার্চ ঢাকায় আসা প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক আলোচনায় দ্রুত তিস্তা চুক্তি সইয়ের তাগিদ থাকছে। তবে সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, তিস্তার বাস্তবায়ন নিয়ে আমরা সবসময় কথা বলি। আগামীকালকে (আজ) দিল্লিতে পানি সম্পদ সচিব পর্যায়ে বৈঠকেও বিষয়টি উঠবে। সেখানে অন্য ৬ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে কথা হবে। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে দুই দেশের পানি সম্পদ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে দুইপক্ষ একমত হয়েছিল। একটি খসড়া কাঠামো চুক্তির ড্রাফট হয়েছিল। ঢাকায় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক পরবর্তী অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সফরের একদিন আগে তিস্তা চুক্তিতে মমতার আপত্তির কথা চাউর হয়। সেই সঙ্গে তার ঢাকা সফরও বাতিল করা হয়। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার ভারতের ক্ষমতায় আসার পর তিস্তা চুক্তি নিয়ে আশার কথা শোনা গেলেও মমতার মত বদল হওয়ার কোনো আলামত মিলেনি বরং এ নিয়ে গত সপ্তাহে মমতা আরো কড়াভাবে আপত্তি করেছেন। তার বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের সঙ্গে মোদির ওরাকান্দি যাত্রার সম্পৃক্ততা উড়িয়ে দিলেন মন্ত্রী: এদিকে সংবাদ সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গোপালগঞ্জের ওরাকান্দি যাত্রার সম্পর্ক রয়েছে মর্মে যে দাবি করেছে বিবিসি এবং ডয়েচে ভেলে তা উড়িয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন। আদতে ওই যাত্রার সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি বা নির্বাচনের সম্পৃক্ততা আছে কিনা? আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের দাবি মতে যদি থাকে তাহলে বাংলাদেশ কেন মোদিকে সেই সুযোগ করে দিচ্ছে? এমন একাধিক প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায় অভিন্ন জবাব দেন। বলেন, না ওই তীর্থস্থান সফরে দেশটির অভ্যন্তরীণ কোনো রাজনৈতিক বিষয় আছে কিনা তা আমি বলতে পারবো না। তা আগে মন্ত্রী বলেন, এটি আমাদের সৌভাগ্য একটি দেশের সরকার প্রধান ঢাকা শহরের বাইরে যাচ্ছেন। তিনি সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী মন্দিরে যাবেন। একটি পুরনো মন্দির এবং সেখানে গিয়ে তিনি স্বল্প সময়ের জন্য প্রার্থনা করবেন। টুঙ্গিপাড়া থেকে তিনি যাবেন ওড়াকান্দি। সেখানকার সংসদ সদস্য শেখ সেলিম এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রধান ফারুক খান তাকে অভ্যর্থনা জানাবেন। ওখানেও তিনি প্রার্থনা করবেন এবং সেখানকার কিছু স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ করবেন। একটি ধর্মীয় এলাকায় যাবেন। ভারতের সরকার একটি ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন একটি তীর্থস্থানে তিনি সম্মান প্রদর্শন করবেন।
৫ নেতার সফরের বিস্তারিত
ওদিকে সংবাদ সম্মেলনের সূচনাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন দক্ষিণ এশিয়ার ৫ নেতার বাংলাদেশ সফরের বিস্তারিত তুলে ধরেন। সেখানে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আফগানিস্তানের শীর্ষ নেতৃত্বকেও ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু দেশটির তরফে এখনো কোনো জবাব আসেনি। প্রতিবেশী মিয়ানমারকে বাংলাদেশ কোন আমন্ত্রণই জানায়নি বলে এক প্রশ্নে খোলাসা করেন মন্ত্রী। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেফ তাইয়্যিপ এরদোগান পরবর্তীতে বাংলাদেশ সফর করবেন বলেও জানান তিনি। মন্ত্রী তার লিখিত বক্তব্যে জানান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপন উপলক্ষে দশদিনব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে যা আগামী ১৭ থেকে ২৬শে মার্চ ২০২১ তারিখ পর্যন্ত জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হবে। দশদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালায় ১৭ই মার্চ, ২২শে মার্চ এবং ২৬শে মার্চের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ১৭ই মার্চ, ১৯শে মার্চ, ২২শে মার্চ, ২৪শে মার্চ এবং ২৬শে মার্চের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা উপস্থিত থাকবেন। এই পাঁচদিনের অনুষ্ঠানে বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকার প্রধানগণ সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। ১৭ই মার্চ অনুষ্ঠানে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ্, ১৯শে মার্চের অনুষ্ঠানে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে, ২২শে মার্চের অনুষ্ঠানে নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভা-ারী, ২৪শে মার্চের অনুষ্ঠানে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং এবং ২৬শে মার্চের অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত থাকবেন। এই পাঁচদিনের অনুষ্ঠানসহ দশদিনের অনুষ্ঠানমালায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের ধারণকৃত ভিডিও বক্তব্য প্রদর্শন করা হবে। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানমালা ইলেক্ট্রনিক ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার করা হবে। দশ দিনব্যাপী এ আয়োজনে বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানগণের বক্তব্য ও ভিডিও বার্তা ছাড়াও বন্ধুরাষ্ট্র সমূহের সাংস্কৃতিক দলের সশরীরে এবং ধারণকৃত পরিবেশনা থাকবে। বিদ্যমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিবেচনায় সীমিত সংখ্যক আমন্ত্রিত অতিথির উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানসমূহ আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ২৬শে মার্চে বাংলাদেশ ও ভারত-দু’দেশের সরকার প্রধানের উপস্থিতিতে ‘বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল চিত্রপ্রদর্শনী’- আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে পরবর্তীতে যা ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে প্রদর্শন করা হবে।
কাল আসছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট: মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মেদ সলিহ্ ১৭শে মার্চ রাষ্ট্রীয় সফরে সস্ত্রীক বাংলাদেশে আসছেন। সফরসঙ্গী হিসেবে তার সহধর্মিণী ফার্স্টলেডি ফাজনা আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল্লাহ শহীদ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রীসহ ২৭জন অতিথি আসবেন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর থেকে দুই দেশ বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মালদ্বীপে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা বিশ ভাগ। তাছাড়া ব্যবসা- বাণিজ্য, মৎস্য, স্বাস্থ্য, পর্যটন সহ ক্ষেত্রভিত্তিক আঞ্চলিক সহযোগিতায় মালদ্বীপের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।