শারীরীক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যান ইকবালের মানবেতর জীবন-যাপন

0

আলী আকবর টুটুল, বাগেরহাট ॥ বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যান ইকবাল হোসেন খান। দেশ ও বিদেশে খেলেছেন একাধিক আন্তর্জাতিক ম্যাচ। দেশের জন্য এনেছেন সম্মান। নিজেও পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার। খ্যাতির দিকে দিয়েও পিছিয়ে নেই তিনি। তবে আর্থিক স্বচ্ছলতা আসেনি তার পরিবারে। চরম আর্থিক সংকটে বিধবা মা ও প্রতিবন্ধী ভাইকে নিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে ইকবালের। জীবিকার জন্যে কাজ করতেন হোটেলে আর খেলতেন জাতীয় দলে। করোনায় হোটেল বন্ধ হয়-বন্ধ হয় টুর্নামেন্টও। তাই আয় বন্ধ। তাছাড়া টাকার অভাবে সিডর ও আইলার তা-বে ল-ভ- ঘরও সংস্কার করতে পারেননি। ভাঙ্গা ঘরে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে বসবাস করেন তারা। তারপরও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতার আশায় আছেন ইকবাল।
মাত্র দেড় বছর বয়সে পোলিও টিকা দেওয়ার ফলে পক্ষাঘাতগ্রস্থ (প্যারালাইজড) হয়ে পড়েন বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার মধ্যকালিকাবাড়ি গ্রামের ইয়াছিন খানের ছেলে ইকবাল হোসেন খান। কয়েক বছর পরে কিছুটা সুস্থ হলেও বাম পায়ের শক্তি কমতে থাকে তার। বয়স যত বাড়তে থাকে বাম-পায়ের উরু থেকে পাতা পর্যন্ত চিকন হতে থাকে। ফলে স্বাভাবিক চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন ইকবাল। তারপরও থেমে থাকেননি। ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা থেকে অদম্য মনবল নিয়ে গ্রামের ছেলেদের সাথে ব্যাট হাতে মাঠে নামেন। পরিবারে স্বচ্ছলতা আনতে খুলনার একটি হোটেলে কাজ নেন তিনি। এর মাঝেই বাংলাদেশ শারিরীক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টিমে চান্স হয় তার। ৪-৫ বছরে দেশে-বিদেশে একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলেছেন তিনি। জাতীয় টিমে খেললেও পরিবারের আর্থিক কষ্ট দূর হয়নি তার। খেলার পাশাপাশি খুলনার একটি খাবার হোটেলে কাজ করে মা ও মানসিক প্রতিবন্ধী ছোট ভাইয়ের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করতেন তিনি। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে টুর্নামেন্ট বন্ধের সাথে সাথে হোটেলের কাজও চলে যায় ইকবালের। ভাঙ্গা ঘর নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন যায় মা ছেলের। এই অবস্থায় সরকারি সহযোগিতার জন্য আবেদন করেছেন প্রতিবন্ধী এই খেলোয়ার।
বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যান ২৮ বছর বয়সী ইকবাল হোসেন খান বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পরে মায়ের মুখে এক মুঠো ভাত তুলে দেওয়ার আশায় খুলনার জাকির হোটেলে কাজ শুরু করি। পায়ের সমস্যার কারণে অন্যের থেকে বেতনও কম পেতাম, আবার কথাও বেশি শুনতাম। সবকিছু সহ্য করে কাজ করে যেতাম। এর মধ্যে একটি পত্রিকায় বাংলাদেশ শারিরীক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টিমের জন্য ক্রিকেটার চেয়ে বিজ্ঞাপন দেয়। বিজ্ঞাপন দেখে আমি আবেদন করি। প্রায় ৫ হাজার প্রতিবন্ধী ছেলেদের সাথে প্রতিযোগিতা করে বাংলাদেশ শারিরীক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টিমে চান্স পাই। এরপরে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি), এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি)এর তত্ত্বাবধায়নে বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট টিমের হয়ে দেশের বাইরে ও ভিতরে একাধিক আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলেছি। লিগও খেলেছি। আসলে আমাদের সুযোগ সুবিধা এত নগন্য যা বলার মত নয়। আমাদের এই টিমকে পরোক্ষভাবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ও বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) তত্ত্বাবধায়ন করে। তবে আমরা তেমন কোন বেতন ভাতা বা সুযোগ সুবিধা পাইনা। ইকবাল আরও বলেন, আমরা ৬ ভাইবোন। চার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ভাইটা মানসিক প্রতিবন্ধী। মাত্র সাড়ে ৭ শতক জমির উপর আমাদের বাড়ি। মাঠে কোনো ধানি জমি নেই। হোটল বন্ধ টুর্নামেন্ট বন্ধ ফলে আয়ও বন্ধ হয়ে যায় আমার। সিডর ও আইলার ঝড়ে বাবার তৈরি কাঠের ঘরটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে বসবাস করতে হয় আমাদের ঘরে। বৃষ্টির পানিতে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে পাওয়া ক্রেস্ট ও সনদপত্রও নষ্ট হয়ে গেছে আমার। ব্যাট, প্যাডসহ খেলার সামগ্রী বহনের জন্য একটি ভাল ব্যাগও নেই সুষ্ঠুভাবে বাঁচার জন্য আমারমত অসহায় শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারদেরকে সরকারি সহযোগিতার আওতায় আনার দাবি জানান ইকবাল হোসেন খান। জেলা ক্রীড়া সংস্থার কোষাধ্যক্ষ সরদার ওমর ফারুক বলেন, বাগেরহাটের একটি প্রতিবন্ধী খেলোয়ার জাতীয় টিমে খেলছে এজন্য আমরা গর্বিত। ইকবাল হোসেনের আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ও বিসিবির সাথে যোগাযোগ করবো।