করোনার ক্ষত কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সিমেন্ট খাত

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ অন্য সব খাতের মতো কভিড-১৯-এর প্রভাব পড়েছিল সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরও। তবে সিমেন্ট খাতের জন্য মহামারীর এ প্রভাব বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির কারণে গত বছর প্রায় তিন মাস সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর উৎপাদন ও ব্যবসা বন্ধ ছিল। পুঞ্জীভূত লোকসানের কারণে নগদ অর্থের সংকটেও পড়েছিল এ খাতের কোম্পানিগুলো। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে গত ছয় মাসে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে সিমেন্ট কোম্পানিগুলো। দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত স্থানীয় সিমেন্ট কোম্পানির অধিকাংশের ব্যবসা চলতি ২০২০-২১ হিসাব বছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে।
পুঁজিবাজারে বর্তমানে সাতটি সিমেন্ট কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ ও লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড বহুজাতিক কোম্পানি। এ দুই কোম্পানির হিসাব বছর শেষ হয়েছে গত ৩১ ডিসেম্বর। ফলে এখনো সর্বশেষ তিন মাসের তথ্য প্রকাশিত হয়নি কোম্পানি দুটির। বাকি পাঁচ কোম্পানির সবগুলোই দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আরামিট ছাড়া বাকি চার কোম্পানির ব্যবসায় উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে আরামিট সিমেন্টের বিক্রি হয়েছে ৯৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আগের বছরের একই সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৯৮ কোটি ৬ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির বিক্রি কমেছে ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। তবে বিক্রি কমলেও আগের বছরের তুলনায় চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী লোকসান কমেছে। চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী লোকসান দাঁড়িয়েছে ৭৯ লাখ টাকা, যা এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯ কোটি ১১ লাখ টাকা।
কনফিডেন্স সিমেন্ট চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৩০৪ কোটি টাকা বিক্রি করেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিক্রির পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৫৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটির বিক্রি বেড়েছে ১৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর চলতি বছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৫৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকায়। আগের বছরের একই সময়ে মুনাফা ছিল ৩৮ কোটি ১২ লাখ টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছে ৫৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
মেঘনা সিমেন্টের বিক্রি চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩০ দশমিক ২৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকায়। একইভাবে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফাও আগের তুলনায় ৪৫ দশমিক ২৯ শতাংশ বেড়ে ২ কোটি ৪৭ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে।
জানতে চাইলে মেঘনা সিমেন্টের কোম্পানি সচিব শাহরিয়ার মোল্লা বলেন, কভিডের কারণে সিমেন্ট খাতের ব্যবসায় যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল, সেটি এখন অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। বাজারে বর্তমানে আমরা ভিআরএম প্রযুক্তির সিমেন্ট সরবরাহ করছি। ভালো মানের সিমেন্ট উৎপাদনের কারণে বাজারে আমাদের সিমেন্টের বেশ চাহিদা রয়েছে। পদ্মা সেতুতে আমাদের সিমেন্ট ব্যবহূত হচ্ছে। সিমেন্ট প্যাকেটজাত করতে ব্যবহূত ব্যাগ আমরা নিজেরাই তৈরি করছি। এতে ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে। এছাড়া গত বছরের নভেম্বরে আমাদের ১০০ কোটি টাকার প্রেফারেন্স শেয়ারের সাবস্ক্রিপশন হয়েছে। ফলে আমাদের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ও শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) বেড়েছে।
এম আই সিমেন্ট চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে ৭০৮ কোটি টাকা বিক্রি করেছে। যেখানে এর আগের বছরের একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ৬৯৫ কোটি টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির বিক্রি বেড়েছে প্রায় ২ শতাংশ। বিক্রি বাড়ার কারণে কোম্পানিটি আগের বছরের লোকসান কাটিয়ে মুনাফায় ফিরতে সক্ষম হয়েছে। চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে এমআই সিমেন্টের ৩০ কোটি ১১ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা হয়েছে। যেখানে এর আগের বছরের একই সময়ে ২৮ কোটি টাকা লোকসান হয়েছিল।
প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে ৫৯৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা বিক্রি করেছে। যেখানে এর আগের বছরের একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ৫২৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির বিক্রি বেড়েছে ১২ দশমিক ৩৮ শতাংশ। বিক্রি বাড়ার পাশাপাশি আগের বছরের তুলনায় চলতি হিসাব বছরের প্রথমার্ধে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা ১১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেড়ে ২৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
প্রিমিয়ার সিমেন্টের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মো. শফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, স্থানীয়, বহুজাতিক, তালিকাভুক্ত এবং অতালিকাভুক্ত প্রায় সব সিমেন্ট কোম্পানিই গত ৬ মাসে ভালো ব্যবসা করেছে। কভিডের কারণে বেশ কয়েক মাস নির্মাণকাজে স্থবিরতা নেমে এসেছিল। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতির কারণে নির্মাণকাজে গতি বেড়েছে। এতে সিমেন্টের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ খাতের কোম্পানিগুলোর আয় বেড়েছে। পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারে সিমেন্টের কাঁচামাল ও জ্বালানি তেলের দাম কমার কারণে কোম্পানির ব্যয় কমেছে। এতে সিমেন্ট খাতের কোম্পানিগুলোর মুনাফাও বেড়েছে।
সিমেন্ট খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে সিমেন্টের বাজার ২৮ হাজার কোটি টাকার। এ খাতে ৩৬টি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করছে। এর মধ্যে পাঁচটি বহুজাতিক। সিমেন্ট খাতের সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ছয় কোটি টন, যদিও ব্যবহূত হচ্ছে সাড়ে তিন কোটি টন। খাতটিতে উদ্যোক্তাদের মোট বিনিয়োগ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ১৪ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে বর্তমানে সিমেন্টের বাজারে শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড আবুল খায়েরের শাহ সিমেন্ট। ১০ শতাংশ মার্কেট শেয়ারের ভিত্তিতে সিমেন্টের বাজারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা বসুন্ধরা সিমেন্টের মার্কেট শেয়ার ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। ৮ দশমিক ১০ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে সিমেন্টের বাজারে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বহুজাতিক সেভেন রিংস সিমেন্ট। আরেক বহুজাতিক কোম্পানি হাইডেলবার্গের দখলে রয়েছে সিমেন্টের বাজারের প্রায় ৬ শতাংশ।