পাঁচ মাসে বাজেট বাস্তবায়ন ২০ শতাংশের নিচে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ করোনা মহামারীর মধ্যেই চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। গত বছরের নভেম্বর শেষে দেখা গেছে, সেখান থেকে সরকারের ব্যয় হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৬ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাজেট বাস্তবায়ন হয়েছে ২০ শতাংশেরও কম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই সব ধরনের উন্নয়নকাজে স্থবিরতা ছিল। এছাড়া সরকারও কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্র সাধনের নীতি নিয়েছে। এ কারণে উন্নয়ন খাতে ব্যয় তুলনামূলক কম হয়েছে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে, যার প্রভাব পড়েছে বাজেট বাস্তবায়ন হারে।
সরকারের বাজেটের বড় অংশই ব্যয় হয় উন্নয়নকাজে। এজন্য প্রতি অর্থবছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে ব্যয়ের একটি লক্ষ্য ঠিক করা থাকে। চলতি অর্থবছর এডিপি বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ৬১১ কোটি টাকা। কিন্তু এক্ষেত্রেও বাস্তবায়ন হার ভালো নয় এবার। গত নভেম্বর পর্যন্ত এডিপি থেকে ব্যয় হয়েছে ৩৮ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। সে হিসেবে অর্থবছরের পাঁচ মাসে এডিপি বরাদ্দের মাত্র ১৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে সরকার। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে এডিপির ১৯ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছিল।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯-এর কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা বিরাজ করছে। তাই রাজস্ব আহরণও তুলনামূলক কম। বিপরীতে এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের ব্যয় বেড়ে গেছে। তাই সরকার ব্যয় নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে চলতি অর্থবছরে এডিপির আওতায় বাস্তবায়নাধীন কম গুরুত্বপূর্ণ ও মধ্যম অগ্রাধিকারের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ খরচ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে ‘মধ্যম অগ্রাধিকার’ প্রকল্পের যেসব খাতে অর্থ ব্যয় না করলেই নয়, সেক্ষেত্রে খরচের বিষয়টি ‘কঠোর’ বিবেচনায় নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্পের অর্থ ব্যয় অব্যাহত রাখতে বলা হয়েছে। ফলে সরকারের খরচ বেশ কমেছে।
তিনি আরো বলেন, যেসব প্রকল্পে অর্থ খরচে কোনো বাধা নেই করোনার কারণে সেসব প্রকল্প স্বাভাবিক গতিতে এগোচ্ছে না। তাই সরকারের খরচ কম হচ্ছে। এছাড়া খরচ কমাতে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে নতুন গাড়ি কেনায় নিষেধাজ্ঞা ৩১ ডিসেম্বর থেকে বাড়িয়ে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের ভ্রমণ ব্যয়ও অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছে সরকার।
করোনায় সবকিছুতে এ ধরনের স্থবিরতায় কেবল সরকারের ব্যয় কমেছে তা নয় আয়ও কমেছে। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সরকার রাজস্ব আয় হয়েছে ৯৬ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ৯৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে আয় কমেছে ৩ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা। পাঁচ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আহরণ করেছে ৮৭ হাজার ৯২ কোটি ৭১ লাখ টাকা। রাজস্ব আহরণের এ পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ বা ২ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা বেশি। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আহরণ হয়েছে ২৩ শতাংশ কম। এ পাঁচ মাসে সরকারের আয়ের বাকি ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা এসেছে এনবিআর-বহির্ভূত রজস্ব থেকে।
অর্থ মন্ত্রণালের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে মোট বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। অর্থবছরের পাঁচ মাসের ঘাটতি মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭ হাজার ৫৭২ কোটি ও বৈদেশিক উৎস থেকে ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা নিট ঋণ গ্রহণ করেছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। এখন সব থেকে ভালো হতো যারা চাকরি হারিয়েছেন তাদের হাতে যদি কিছু টাকা দেয়া যেত। এটি করা গেলে অর্থনীতিতে গতি আসত। এসএমই খাতকে প্রচুর পরিমাণ সহযোগিতা করতে হবে। তাহলে মানুষের হাতে কিছু টাকা যাবে। এছাড়া করোনার কারণে এডিপির বাস্তবায়নও একেবারে কমে গেছে। কিন্তু এটা বাড়াতে হবে। দরকার হলে সময়োপযোগী নতুন প্রজেক্ট নিয়ে এডিপি বাস্তবায়ন হার বাড়াতে হবে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সরকার উন্নয়নকাজে যা ব্যয় করেছে তা ১১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নে যে অর্থ সরকার ব্যয় করেছে তা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ শতাংশ কম। এ অবস্থায় শতভাগ এডিপি বাস্তবায়ন করতে হলে শেষ সাত মাসে প্রায় ৮২ শতাংশ বা ১ লাখ ৭৬ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে।
শুরুতে কাজে গতি না এলে শেষ মুহূর্তে এডিপি বাস্তবায়নে বড় ধরনের চাপ পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাড়াহুড়োর কাজে গুণগত মান নিশ্চিত করা কঠিন হবে বলে মন্তব্য করে তারা সরকারি অর্থ অপচয়েরও আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এমনকি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে মূল্য বাড়ানোর শঙ্কাও রয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এডিপি বাস্তবায়ন ঠিকমতো করতে পারলে বাজেট ঘাটতি আরো বাড়ত। কিন্তু এডিপির বাস্তবায়ন কমিয়ে বাজেট ঘাটতি কমানোর নীতিটা শ্লথ বাস্তবায়ন ও শ্লথ অর্থনীতির পরিচায়ক। সরকারি ব্যয়গুলো যদি আমরা দ্রুততার সঙ্গে করতে না পারি তাহলে একদিকে উন্নয়নকাজ বিলম্বিত হবে, অন্যদিকে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে খরচও বাড়ানো হবে। এগুলোর কোনোটাই ইতিবাচক নয়। আমরা সরকারের বাস্তবায়ন ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বারবার বলে আসছি। সেটা বাড়াতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বিশেষ করে কভিড-১৯ থেকে উত্তরণের পরিপ্রেক্ষিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ চাঙ্গা করার জন্য এডিপির বাস্তবায়ন বাড়াতে হবে। রাজস্ব আদায়ে যে শ্লথ গতি এতে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। তাই করের আওতা বাড়িয়ে সরকারের রাজস্ব আয় আরো বাড়াতে হবে। আবার আহরিত সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও দক্ষতা অর্জন করতে হবে।