বৈশ্বিক কৃষিপণ্য বাজারে থাকবে চীনা আমদানি আর লা নিনার প্রভাব

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে চীনা আমদানি। সেই সঙ্গে জলবায়ু সম্পর্কিত বিষয়গুলো উৎপাদনে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে। কারণ এ বছরই লা নিনার প্রভাবে বেশ কয়েকটি দেশে অতিবৃষ্টি ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা হ্রাসের কারণে বিশ্বব্যাপী বায়ুমণ্ডলীয় ও মহাসাগরীয় ঘটনাকেই বলে লা নিনা। এবারের কৃষিবাজারে লা নিনার প্রভাবও ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যাবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। খবর মানি কন্ট্রোল।
মহামারী-পরবর্তী চীনা নাগরিকদের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ বছর ব্যাপকভাবে মজুদ বৃদ্ধি করবে এবং আফ্রিকার সোয়াইন ফিভারের (এএসএফ) প্রাদুর্ভাবে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির পর শূকর উৎপাদন পুনরুদ্ধার হতে শুরু করবে। ফলে খামারের পশুখাদ্য জোগান দিতেও বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্যের দরকার পড়বে।
ট্রেডিং ইকোনমিকস ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, গত মাসের পর থেকে সয়াবিন, গম, ভুট্টা ও চিনির মতো কৃষিপণ্যের দাম কমপক্ষে ১০ শতাংশ বেড়েছে।
ডাচ মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান আইএনজির পণ্য কৌশল বিভাগের প্রধান ওয়ারেন প্যাটারসন বলেন, ২০২০ সালে চীনের আমদানি বৃদ্ধির কারণে সয়াবিন, ভুট্টা, গম ও চিনির দাম উল্লেখযোগ্য বেড়েছে।
২০২০ সালের জানুয়ারি-অক্টোবরে চীনের সয়াবিন আমদানি ছিল আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেশি। দেশটিতে ভুট্টার চালানের পরিমাণ বেড়েছে ৯৭ শতাংশ, চিনির আমদানি বেড়েছে ২৮ শতাংশ এবং গম ক্রয় বেড়েছে ১৬৩ শতাংশ।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের প্রথম পর্যায়ের বাণিজ্য চুক্তি পণ্যগুলোর আমদানিতে ভূমিকা রেখেছিল, তবে চিনে ক্ষতিগ্রস্ত শূকর খামারগুলোর পুনরুদ্ধারও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
মাংস খাওয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী যে ৬৭৭ দশমিক ৬টি শূকর উৎপাদন হয়, এর মধ্যে ৩১৯ মিলিয়নেরও বেশি উৎপাদন করে চীন।
প্যাটারসন বলেন, যে ১৯৯৯ সালে এএসএফের প্রাদুর্ভাবে চীনের শূকরের সংখ্যা ১৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে যায়। এরপর চীন সরকার শূকর উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। কারণ চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শূকরের মাংসের ভোক্তা। এএসএফের প্রাদুর্ভাবে খামারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দেশটিতে শূকরের মাংসের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল।
প্যাটারসন চীন সরকারের উপাত্তের ভিত্তিতে বলেন, গত অক্টোবরেই আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চীনে শূকরের সংখ্যা প্রায় ২৭ শতাংশ বেড়েছে।
সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের শুরু থেকে কমপক্ষে ১৩ হাজার বৃহৎ আকারের খামার স্থাপন করা হয়েছিল। এএসএফের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এ-জাতীয় আরো ১৫ হাজার খামার পুনরায় উৎপাদনে ফিরেছে। ফলে শূকরছানার দাম ৫০ শতাংশ কমে গেছে এবং মাংসের দামও কমেছে।
এটিকে চীনে পশুখাদ্যের জোরালো চাহিদা বৃদ্ধির প্রাথমিক কারণ হিসেবে দেখা হয়। ফলে বিশ্ববাজারে ভুট্টা ও সয়াবিনের দামেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে।
প্যাটারসন বলেন, চীনকে তাদের মজুদ নতুন করে তৈরি করতে হয়েছিল, যা তারা পরে পশু খামারে কাজে লাগিয়েছে। ফলে ভুট্টার বাজারে দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল।
এ প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করেছে চীনের জৈব জ্বালানি সম্পর্কিত একটি প্রতিশ্রুতি। চীন সরকার পেট্রলের সঙ্গে ১০ শতাংশ ইথানল মিশ্রণের একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তবে গত বছর কম মজুদ ও সীমিত উৎপাদন সক্ষমতার কারণে এ কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছিল। এ বছর সেটি আবার শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চীন ২০২০ ও ২০২১ সালের মধ্যে ২০০ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন পণ্য ও পরিষেবা কিনতে সম্মত হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত দেশটি সেই লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৫৮ শতাংশ পূরণ করতে পেরেছে। ধরে নেয়া যায়, এখন তারা কৃষিপণ্য ক্রয়ের মাধ্যমে এ লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা করবে, যা ঘুরেফিরে পণ্যগুলোর আন্তর্জাতিক বাজারকেই লাভবান করবে।
আইএনজির প্যাটারসন বলেন, ২০১২-১৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভুট্টার বৃহত্তম ক্রেতা চীন। এটি বেইজিংয়ের বার্ষিক আমদানি কোটা সাত মিলিয়ন টন ছাড়িয়ে গেছে।
অন্যদিকে মার্কিন চলতি বিপণন বছরে (আগস্ট অবধি) চীনকে রেকর্ড ২৯ দশমিক ২ মিলিয়ন টন সয়াবিন বিক্রির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) এ বিপণন বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীনের সয়াবিনের চাহিদা ১০০ মিলিয়ন টন অনুমান করেছে। তবে অন্য বিশ্লেষকরা এ চাহিদা আরো বেশি বলেই মনে করছেন।
অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা হ্রাসের ফলে বিশ্বব্যাপী বায়ুমণ্ডলীয়-মহাসাগরীয় ঘটনা লা নিনার প্রভাব বৈশ্বিক কৃষিবাজারকেও সমর্থন করবে।
বিশ্বের বেশকিছু দেশের মধ্যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, সোমালিয়া ও ইথিওপিয়ায় লা নিনার প্রভাব পড়তে। এর প্রভাবে বিশ্বের কিছু অংশে ভারি বৃষ্টিপাত এবং বন্যা হবে, অন্য অংশে দেখা দিতে পারে খরা।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, লা নিনা কমপক্ষে মার্চ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এটি সম্প্রসারণের সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং কৃষিপণ্যের বাজারে চাঙ্গা ভাব বজায় রাখতে লা নিনাও এ বছর দারুণ ভূমিকা রাখবে বলেই মনে করা হচ্ছে।