প্রকল্পের সোয়া কোটি মেরে দিলেন কর্মকর্তারা!

0

শেখ মাসুদ হোসেন, সাতক্ষীরা॥ ‘আমার বাড়ি আমার খামার, বদলাবে দিন তোমার আমার’ এই স্লোগানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ-১ ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প। কিন্তু সাতক্ষীরায় এই প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করে কেউ করেছেন বাড়ি আবার কেউ কিনেছেন গাড়ি। সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় এই প্রকল্পের এক কোটি ২৭ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শাখা ব্যবস্থাপক, জুনিয়র কর্মকর্তা ও দুই মাঠকর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্ত হওয়া এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হয়েছে বিভাগীয় মামলা। এছাড়া আত্মসাৎকৃত টাকার মধ্যে বুধবার (৯ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ২০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের বর্তমান কর্মকর্তা।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বৈকারি, কুশখালী, বাঁশদহা ইউনিয়নে হয়েছে এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম। সদর উপজেলার তলুইগাছা গ্রামের আকলিমা খাতুন ২০১৪ সালে একটি বাড়ি একটি খামার সমিতির সদস্য হয়েছিলেন। প্রতি মাসে সঞ্চয়ের টাকাও জমা দিচ্ছেন। তবে অফিস থেকে এখনো কোনো টাকা জমা দেয়ার বই পাননি তিনি। আকলিমা খাতুন জানান, আমাকে এখনও বইটাও দিলো না। অন্যদিকে অডিট অফিসার বাড়িতে এসে জানিয়ে গেছেন আমি ১০ হাজার টাকার ঋণ নিয়েছি। এ ঋণের বিষয়ে কিছুই জানি না। তলুইগাছা গ্রামের কামরুজ্জামান জানান, সমিতির কর্মকর্তারা তার বাবা, ভাই ও বোনের নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। বৃদ্ধ নাসের সরদার বলেন, তিনি কখনও অফিসে যাননি। কোনো কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেননি। অথচ তার নামে ঋণ নেয়া হয়েছে ২০ হাজার টাকা। সদস্য বই তার বাড়িতে আছে। কিভাবে এই ঋণের টাকা দেয়া হলো আর কে উঠালো এই টাকা?
এমন অভিযোগ একই গ্রামের রিক্তা খাতুন, আহাদ আলী, মনিরুজ্জামান, তৈয়েব আলী, পারভীন খাতুন, হাছিনা খাতুন, নাজমা খাতুন, আবেদা বেগমসহ সকল সদস্যের। তারা জানান, তাদের স্বাক্ষর ছাড়া কিভাবে টাকা উত্তোলন হয়। টাকাগুলো কে নেয়। সদস্য বইটিও অফিসের লোকজনের কাছে কেন থাকে? আমরাই জানি না অথচ আমাদের নামে ঋণ নেয়া হয়েছে। তলুইগাছা গ্রামের আলী হোসেন, হামজের আলী বলেন, আমরা ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। ঋণের টাকা সুদসহ পরিশোধ করেছি। তবে অফিসে জমা হয়নি। গ্রাহকের টাকায় বাড়ি গাড়ি করেছেন কর্মকর্তারা। বাঁশদহা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন জানান, আমার ও আমার মায়ের নামে কে বা করা অফিস থেকে ঋণ নিয়েছে। অথচ আমি কিছু জানি না। আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের ঢাকা অফিস থেকে অডিট অফিসার এলাকায় আসার পর ঘটনাটি জানতে পারি। তিনি বলেন, অন্য গ্রাহকরাও তখনই এসব জেনেছেন। এখন প্রতিদিন আমার অফিসে এসে হাতে পায়ে ধরছে ওই কর্মকর্তারা। তবে তার ও তার মায়ের নামে কত টাকা তোলা হয়েছে সে ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ দফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ২০১৪ সালে শুরু হয় একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্প। পরবর্তীতে এই প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে দেওয়া হয় আমার বাড়ি আমার খামার। সরকারিভাবে পরিচালিত এই প্রকল্পে উপজেলার গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে সমিতি। বর্তমানে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ১২ হাজার সদস্য রয়েছে এই প্রকল্পে। এরমধ্যে প্রায় এক হাজার সদস্যের টাকা তছরুপ করেছেন আগের কর্মকর্তারা। অডিট অনুযায়ী এক কোটি ২৭ লাখ টাকা খোয়া গেছে প্রকল্পের গ্রাহকদের। এর মধ্যে ১৯ লাখ টাকা উদ্ধার করেছে বর্তমানে দায়িত্বে থাকা অফিসার। এসব ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শাখা ব্যবস্থাপক ও উপজেলা সমন্বয়কারী মেহেদী হাসান, জুনিয়র অফিসার আব্দুল মুকিত, মাঠকর্মী রফিকুল ইসলাম ও শরিফুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের সাতক্ষীরা শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক ও উপজেলা সমন্বয়কারী মেহেদী হাসান বলেন, আমি কোনো টাকা আত্মসাৎ করিনি। যারা টাকা নিয়েছেন তারা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তবে তার মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল ছিল বলে স্বীকার করেন। বরখাস্ত হওয়া জুনিয়র অফিসার আব্দুল মুকিত জানান, আমি ৫৩ লাখ টাকার মতো নিয়েছি। এই টাকা বাড়ির কাজে ব্যবহার করেছি। কিছু টাকা ইতোমধ্যে ফেরতও দিয়েছি। তবে আমার কাছে অতিরিক্ত টাকা দাবি করা হচ্ছে। আমার পক্ষে অতিরিক্ত টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব নয়।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের বর্তমান সিনিয়র অফিসার বিশ্বজিত সরদার জানান, দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর গত ২০ আগস্ট জুনিয়র অফিসার আব্দুল মুকিব সাময়িকভাবে বরখাস্ত হন। এরপর ২২ আগস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হেড অফিস থেকে এলাকায় গিয়ে অডিট কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর শাখা ব্যবস্থাপকসহ আরও তিনজন সাময়িক বরখাস্ত হন। ১৭ সেপ্টেম্বর আমি সাতক্ষীরা শাখা অফিসে যোগদান করি। বরখাস্ত হওয়া চারজনসহ সাতক্ষীরা শাখা অফিসের ৮ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। সেটি চলমান রয়েছে। তিনি আরও জানান, আত্মসাৎ হওয়া টাকার মধ্যে আব্দুল মুকিত আত্মসাৎ করেছেন ৭৬ লাখ টাকা, মাঠকর্মী রফিকুল ইসলাম ৪২ লাখ টাকা ও শরিফুল ইসলাম ৯০ হাজার টাকা। বাকি টাকা তছরুপ হয়েছে। তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে বরখাস্ত করা হয়েছে। আত্মসাৎ হওয়া এক কোটি ২৭ লাখ টাকার মধ্যে অদ্যবদি আমি ২০ লাখ টাকা উদ্ধার করতে পেরেছি। বাকি টাকা উদ্ধারের জন্য তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।