অর্থপাচার : ধরাছোঁয়ার বাইরে আসামিরা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রীয় অর্থ লুট করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন অনেকে। এখন তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। মামলার আগে বা পরে কোনো না কোনো কৌশল অবলম্বন করে দেশত্যাগ করেছেন। গত এক দশকে অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত এমন একশ’র বেশি ব্যক্তি এখন বিদেশে পলাতক। যাদের কারো কারো বিরুদ্ধে রয়েছে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রায়ই এই পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে এনে আইনের মুখোমুখি করার কৌশল জানান দেয়। কিন্তু গত এক দশকে শতাধিক ব্যক্তি অর্থ নিয়ে দেশ ত্যাগ করলেও তাদের ধরা সক্ষম হয়নি। এমনকি অর্থপাচারকারীদের বিষয়ে দুদকের ভূমিকা কি তা হাইকোর্টও সম্প্রতি জানতে চেয়েছেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত দুদকের মামলায় আসামি হওয়া ৬০ জনেরও বেশি ব্যক্তি কানাডা, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে রয়েছেন। যাদের বিষয়ে নানা কৌশল অবলম্বন করেও আইনের মুখোমুখি করানো সম্ভব হয়নি। এমনকি এসব ব্যক্তির মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থও সম্ভব হয়নি ফেরানো। দুদক জানিয়েছে, পাচার হওয়া অর্থ ও পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দেশে ফেরাতে নানা উদ্যোগ এরইমধ্যে নিয়েছে সংস্থাটি। তাদের অবস্থান নিশ্চিত করতেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহযোগিতাও নেয়া হবে। অর্থপাচার করে বিদেশে পালিয়ে আছেন এমন ব্যক্তির মধ্যে সময়ের সবচেয়ে আলোচিত হলেন লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স সার্ভিস লিমিটেডের সাবেক এমডি ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার। তার বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও তা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। দুদকের মামলাও রয়েছে। ২৪৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা পাচারের অভিযোগে গত জানুয়ারিতে মামলা করে সংস্থাটি। পরবর্তীতে গণমাধ্যমে পিকে হালদারের আর্থিক অনিয়মের নানা চিত্র প্রকাশের পর হাইকোর্টও আদেশ দেন। আর্থিক খাতের এই মাফিয়াকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে। একই সঙ্গে রয়েছে দেশে ফেরা মাত্রই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
দুদকের বিভিন্ন সময়ের মামলার সূত্রে জানা যায়, আরো বেশকিছু আসামি অর্থপাচার করে বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন। এরা হলেন- শেয়ার খাতের ব্যবসায়ী লুৎফর রহমান বাদল, যুবলীগের বহিষ্কৃত দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান ও তার স্ত্রী সুমী রহমান, বিসমিল্লাহ গ্রুপের এমডি খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী, সোলায়মানের স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান নওরিন হাবিবসহ সাত আসামি। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম ছাড়াও ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি মোনায়েম খান, জিএম মোহাম্মদ আলীসহ বিশ আসামি। এ ছাড়া হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ূন কবিরসহ পাঁচজন। এ ছাড়াও অ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজের মালিক শহিদুল ইসলাম, স্টার স্পিনিং মিলসের মালিক আবদুল বাছির, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের মালিক জিয়াউর রহমান, আনোয়ারা স্পিনিং মিলসের মালিক জাহাঙ্গীর আলমসহ সব মিলিয়ে শতাধিক আসামি বিদেশে পালিয়ে আছেন।
এদিকে টাকা নিয়ে পালিয়ে বিদেশে বসবাসরতদের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনও এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, সরকারের কাছে এমন ২৮টি ‘কেস’ রয়েছে। যাদের মধ্যে রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীও রয়েছেন। এরপর দুদকও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে ওই তথ্যের ভিত্তিতে তালিকা চেয়েছে। অর্থপাচারকারী ও বিদেশে পলাতকদের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব দিলোয়ার বখ্‌ত মানবজমিনকে বলেন, এ বিষয়ে কতটুকু আপডেট হয়েছে জানা নেই। এর আগে অর্থপাচারকারীদের বিষয়ে তথ্য চেয়ে কানাডা, আমেরিকাসহ বিশ্বের ৫০টি দেশে মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল আসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়েছে দুদক। সংস্থাটির একটি সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ২৭টি এমএলএআর-এর চিঠির জবাব দিয়েছে। পরবর্তীতে গত ২২শে অক্টোবর বিদেশে বিনিয়োগের আড়ালে অর্থপাচার করে যেসব বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব নিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে তাদের তালিকা চেয়েছে দুদক। সংস্থাটির মহাপরিচালক (মানি লন্ডারিং) আ ন ম আল ফিরোজ এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠান মন্ত্রণালয়ে। এতে বলা হয়, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে মিস-ইনভয়েসিং, হুন্ডি, ব্যাংক ক্যাশ ট্রান্সফারের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের নাগরিকদের একাংশ অর্থপাচার করে বিনিয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে। বহুল আলোচিত পানামা পেপার্স, প্যারাডাইস পেপার্স ইত্যাদি কেলেঙ্কারিতে বিভিন্ন বাংলাদেশি নাগরিকের নামও উঠে এসেছে। এই ধারা বন্ধ না হলে অর্থনৈতিক গতি ভবিষ্যতে থমকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে আরো বলা হয়, অর্থপাচারের মাধ্যমে বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণ রোধের লক্ষ্যে আইনি পদক্ষেপের মাধ?্যমে সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনা জরুরি। এর ফলে একদিকে অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে দেশের সম্পদ ফেরত আনার পাশাপাশি অন্যদের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার পাশাপাশি রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এতো কঠিন কাজ সম্পন্ন সম্ভব নয় বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, দুর্নীতি দমন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সহায়তা নেয়ার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রাথমিক পর্যায়ে এই ধরনের বাংলাদেশিদের তথ্য কূটনৈতিক চ্যানেলে সংগ্রহ করবে। এরপর দুদকে সরবরাহ করবে। এতে দুদক দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবে। এ লক্ষ্যে যেসব বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন, তাদের সম্পর্কে তথ্য দূতাবাস বা অন্য কোনো মাধ?্যমে উপায়ে পাওয়া যাবে কি না, তা জানানোর জন্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে দুদক।