স্বপ্ন ভাঙছে লাখ লাখ শিক্ষিত যুবার

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ রাজশাহী সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী হুমায়রা জান্নাত। বাবা অটোরিকশাচালক। অনেক সংগ্রাম করেই স্নাতক ৩য়বর্ষে এসে পৌঁছেছেন। স্বপ্ন ছিল স্নাতক শেষ করেই একটা ভালো চাকরি করবেন; সংসারের হাল ধরবেন। কিন্তু করোনায় যেন সব থমকে গেল। ৩য় বর্ষের পরীক্ষাই ছিল হুমায়রার শেষ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া। এরপর আর ক্লাসে ফেরা হয়নি। পরীক্ষার রেজাল্টও পাননি এখনো।
করোনায় যেমন তার সযত্নে লালন করা স্বপ্নগুলো ভেঙেছে, তেমনি এক অনিশ্চিত ভাবিষ্যতের কালো মেঘ যেন তাড়া করছে প্রতিনিয়ত। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ২০১৮ সালে স্নাতকোত্তর করেছেন সাইফুল ইসলাম। এরপর থেকেই তিনি একাধিক সরকারি চাকরিতে আবেদন করেছেন। বেসরকারি চাকরির চেষ্টাও করেছেন। আশা করেছিলেন, এই বছর একটা ভালো চাকরি হয়ে যাবে। কিন্তু করোনার কারণে তার সেই স্বপ্ন থমকে গেছে। ঢাকা কলেজ থেকে সদ্য অনার্স শেষ করেছেন নাটোরের হাসান। চতুর্থবর্ষের পরীক্ষা শেষেই শুরু হয় করোনার প্রাদুর্ভাব। শহর ছেড়ে চলে যান গ্রামে। অনার্স শেষ করে চাকির স্বপ্ন থাকলেও সে স্বপ্ন যেন ভাঙার পথে। বর্তমানে রাকিব গ্রামে গিয়ে বাবার সঙ্গে সংসারের কাজে সহযোগিতা করছেন। নাটোরের আরেকজন মেধাবী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ৩য়বর্ষের শিক্ষার্থী হাসিদুল ইসলাম। কৃষক বাবার অভাবের সংসারে সংগ্রাম করেই এগিয়েছেন এতোদূর। ভালো রেজাল্ট করায় পেয়েছেন স্কালারশিপও। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে দায়িত্ব অনেক। অনার্স শেষ করে তাই স্বপ্ন দেখেছিলেন একটা ভালো চাকরির। কিন্তু করোনায় সব যেন এলোমেলো। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যেখানে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেখানে এই অদম্য মেধাবী এখন গ্রামে গিয়ে কৃষিকাজ করেন। ভালো রেজাল্টের মূল্যায়নে ব্যাংক থেকে যে স্কলারশিপ পেতেন তাও আপাতত বন্ধ। তাই বাধ্য হয়েই কৃষিকাজ শুরু করেন। শুধু হুমায়রা, সাইফুল, রাকিব কিংবা হাসিদুল নন, করোনাকালে পড়ালেখা ও চাকরির বাজার স্থবির হয়ে পড়ায় এমন লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। অনুসন্ধানে গত দুইদিনে দেশের কয়েকটি অঞ্চলের এমন অন্তত ১০-১৫ জনের সঙ্গে কথা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনাকালে একদিকে যেমন অনেক সরকারি চাকরির পরীক্ষা বাতিল হয়েছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগতো দূরের কথা; বরং ছাঁটাই চলেছে। অন্যদিকে অনার্স কিংবা মাস্টার্স শেষবর্ষের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী চাকরিতে প্রবেশের যোগ্যতাই অর্জন করতে পারছেন না। এ অবস্থায় এসব শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থী উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন পার করছেন। ওদিকে এমনিতেই দেশে বেকারত্বের হার অনেক। আর করোনার কারণে সেই সংকট দিন দিন আরো ঘনীভূত হচ্ছে।
মুঠোফোনে কথা হয় রাজশাহীর পুঠিয়ার বাসিন্দা হুমায়রা জান্নাতের সঙ্গে। তিনি বলেন, এই মহামারির কারণে সবকিছুই থমকে আছে। অনেক কষ্ট করে ৪র্থবর্ষে উঠলাম। কিন্তু এখনো ক্লাস করতে পারলাম না। ইচ্ছা ছিল অনার্স শেষ করেই একটা চাকরিতে ঢুকবো। কিন্তু কবে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবো, কবে অনার্স শেষ করবো তারপর চাকরি করবো। কারণ একটা বছর এভাবেই চলে গেল। চাকরি-বাকরি করে যখন বাবার সংসারে একটু হেল্প করবো, তখন নিজেই সংসারের বোঝা হয়ে আছি। বাবা বিয়ের জন্য পাত্র দেখছেন কিন্তু আমার পরিকল্পনা ছিল অন্তত একটা ভালো কিছু না করে বিয়ে করবো না। সংসারে আমার একমাত্র ছোট বোন। তারও একই অবস্থা যদিও সে এখনো ছোট। তাছাড়া বাবার আয়- রোজগার তেমন না। বিয়ে করলেও তো তার অনেক খরচ আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হুমায়রা বলেন, সবমিলিয়ে একটা অনিশ্চিত সময় পার করছি। জানি না ভবিষ্যৎ কোনদিকে যাচ্ছে। স্নাতকোত্তর শেষ করা সাইফুল ইসলাম বলেন, কিছুদিন আগে দুই-একটা পরীক্ষা হলেও আপাতত নতুন কোনো সার্কুলার নেই। কোনো চাকরির পরীক্ষাও নেই। এই মহামারি কবে শেষ হবে, কবে আবার চাকরির প্রক্রিয়া শুরু হবে- জানি না। তিনি বলেন, আমরা যারা বেকার আছি, তাদের চাকরির খুব প্রয়োজন। এই মহামারির কারণে জীবনটা অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কোনো কাজ নেই, যতদিন যাচ্ছে পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছি। মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা আমাদের নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা দিন দিন আরো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দিন যতো যাচ্ছে অনিশ্চিয়তা ততোই বাড়ছে। এই মুহূর্তে আমরা মা-বাবা আর পরিবারের দায়িত্ব নেবো। অথচ তারাই আমাদের জন্য টেনশনে পড়েছেন। আমাদের হতাশা তাদেরও হতাশার কারণ হয়েছে। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী হাসান বলেন, ঢাকায় টিউশনি করে পড়ালেখার খরচ চালাতাম। করোনা শুরু হলে সংকটে পড়ে গ্রামে চলে যাই। ভেবেছিলাম যেহেতু অনার্স শেষ করেছি সুতরাং পরিস্থিতি ভালো হয়ে গেলে চাকরি শুরু করবো। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। সব চাকরি পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেল। নতুন করে সার্কুলার নেই। তবুও আশায় বসে আছি কবে পরিবেশ ভালো হবে। এ অবস্থায় বাড়িতে আছি। বাবার কাজে সহযোগিতা করি। পাশাপাশি চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রস্তুতি নিতে থাকি দেখা যাক আল্লাহ্‌ ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিদুল ইসলাম বলেন, বাবা কৃষিকাজ করে পড়ালেখা শিখিয়েছেন। অভাবের সংসারে এমনিতেই নানা টানাপড়েন। এরমধ্যে আবার করোনার সংকট। এ অবস্থায় উপায় না পেয়ে গ্রামে কৃষিকাজ শুরু করেছি। এসএসসি-এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়ায় দু’টি ব্যাংক থেকে স্কলারশিপ দেয়ায় পড়ালেখা কোনোভাবে চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এরমধ্যেই করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলো। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গ্রামে চলে আসি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগ পর্যন্ত গ্রামেই একটা কিছু করে খেতে হবে। অন্য কোনো উপায় দেখছি না।
সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর দেশের প্রায় ২০ লাখ তরুণ-তরুণী চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। এদের বড় একটি সংখ্যক স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে সরকারি- বেসরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু এবার করোনার কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে চাকরির বাজার। বছর ধরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ। একদিকে সেশনজটের কারণে শিক্ষার্থীদের চাকরির বয়সও চলে যাচ্ছে। অপরদিকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পড়ালেখা শেষ করে বসে আছেন। এছাড়া একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষাও। পিএসসি’র সব নিয়োগ পরীক্ষা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। ৪০তম ও ৪১তম বিসিএস’র কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। সমপ্রতি ৪২ ও ৪৩তম বিসিএস’র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এই চারটি বিসিএসসহ পিএসসি’র অধীন নিয়োগ পরীক্ষাগুলো কবে হবে, তা নিয়েও চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে রয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এর মধ্যে ৪০তম বিসিএস-এ ফলাফলের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করছেন চাকরিপ্রার্থীরা। গত বছরের মে মাসে ৪০তম বিসিএস’র প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এর প্রার্থী ছিলেন চার লাখ ১২ হাজার ৫৩২ জনের বেশি। ওদিকে সরকারি চাকরির অন্যতম বড় খাত ব্যাংক। এ খাতের নিয়োগ পরীক্ষাও আটকে আছে। নতুন করে কোনো নিয়োগ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পায়নি। করোনা সংকটের মন্দাভাবের কারণে ব্যাংকিং, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানও কর্মী ছাঁটাই করেছিল। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও নতুন করে নিয়োগও দেয়া হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে চাকরির বিজ্ঞাপনও অনেক কমে গেছে। যেসব চাকরির বিজ্ঞাপন আসছে সেখানেও অভিজ্ঞ কর্মী চাওয়া হচ্ছে। আগে যে রকম বিজ্ঞাপন আসতো, করোনার কারণে সেটা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে গেছে। করোনার শুরুতে দেশের ব্যাংক ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ব্যবসায় মন্দার কারণ দেখিয়ে কর্মী ছাঁটাই কিংবা কর্মীদের বেতন কমিয়ে দেয়। এখন কার্যক্রম কিছুটা স্বাভাবিক হলেও নতুন করে নিয়োগ দেয়ার কথা ভাবছেন না কেউই। ব্যাংকগুলো বলছে, আগে থেকেই খেলাপি ঋণের চাপ, তারল্য সংকট, তার ওপর ব্যবসা বাণিজ্যের অবনতির কারণে করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবে তাদের ব্যবসা খাদের কিনারে। এ অবস্থায় তাদের ব্যয় কমানো ছাড়া বিকল্প পথ নেই। সেজন্য নিয়োগ প্রক্রিয়াগুলো আপাতত থেমে আছে। এ অবস্থায় এ খাতে যেসব শিক্ষার্থী আত্মনিয়োগ করার স্বপ্ন বুনেছিলেন, তারা হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।