ঋণপত্র ছাড়াই ক্রয়াদেশ দিচ্ছে ৫৬% ক্রেতা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥বাংলাদেশের পোশাক সরবরাহকারী কারখানা সিকেডিএল। গত বছরের শেষে মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান কোল্ডওয়াটার ক্রিকের (সিডব্লিউসি) পক্ষ থেকে ওপেন অ্যাকাউন্টে বিক্রয় চুক্তি বা সেলস কন্ট্রাক্টের বিপরীতে পোশাক সরবরাহের ক্রয়াদেশ পায় সিকেডিএল। নির্ধারিত সময়ে রফতানির লক্ষ্যে পণ্য জাহাজীকরণ সম্পন্ন হয়। কিন্তু পণ্যের বিপরীতে ক্রেতার পক্ষ থেকে দাম পরিশোধ হয় আংশিক। এদিকে কভিড সংকটের অজুহাতে ব্যবসা গুটিয়ে নেয় ক্রেতা। ফলে এখন পর্যন্ত অপরিশোধিত অর্থ আদায় করতে পারেনি সিকেডিএল।
বাংলাদেশে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পরিচালনার অন্যতম গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হলো ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণপত্রের ব্যবহার। তবে গত কয়েক বছরে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে সেলস কন্ট্রাক্টের ব্যবহার বেড়েছে। এ পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক খরচ ও সময় কমিয়ে আনার পাশাপাশি পণ্যের দাম পরিশোধের বাধ্যবাধকতা তুলনামূলক কম। সব দিক বিবেচনায় ব্যবসায়িক সম্পর্কের ধরন ভেদে বিক্রয় চুক্তিই বেছে নিচ্ছেন ক্রেতা ও বিক্রেতা দুপক্ষই। কিন্তু বিক্রয় চুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দাম পরিশোধ না হওয়ার মতো ঘটনাও বাড়ছে। আর কভিড-১৯ প্রেক্ষাপট ঋণপত্রের ব্যবহার থেকে ক্রমেই সরে আসছে ক্রেতারা। ঋণপত্রে ক্রেতাদের অনাগ্রহে মূল্য অপরিশোধের ঝুঁকিও বাড়ছে রফতানিকারকদের।
পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্ট কারখানা মালিক পক্ষগুলো বলছে, ঋণপত্র ছাড়া শুধু সেলস কন্ট্রাক্টের বিপরীতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার দায় ক্রেতা ও বিক্রেতা দুই পক্ষেরই। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বড় নিয়ামক হলো ক্রেতা ও বিক্রেতার আস্থার সম্পর্ক। আর এ সম্পর্কের জের ধরেই ক্রেতারা প্রস্তাব দিলে ঋণপত্র ব্যবহার না করে শুধু সেলস কন্ট্রাক্টের বিপরীতে রফতানিতে রাজি হচ্ছেন পোশাক রফতানিকারকরা। কভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে ক্রেতারা বিক্রয় চুক্তি করে ব্যাংকে টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফারের (টিটি) মাধ্যমে পণ্যের দাম পরিশোধে আগ্রহও বেশি প্রকাশ করছেন। কিন্তু এ পরিস্থিতিতে দাম পরিশোধের অনিশ্চয়তা থাকলেও তুলনামূলক সহজ বাণিজ্য পদ্ধতি অনুসরণের দিকে ঝুঁকছেন তারা। বর্তমানে ক্রেতাদের ৫৬ শতাংশই ঋণপত্র ছাড়া অন্যান্য পদ্ধতিতে ক্রয়াদেশ দিতে চাইছেন বলে জানিয়েছেন পোশাক শিল্পের মালিক প্রতিনিধিরা।
জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, মহামারী পোশাক খাতের ঝুঁকির জায়গাগুলো উন্মোচন করেছে। বর্তমানে ক্রেতাদের সঙ্গে হওয়া চুক্তিগুলো খুবই দুর্বল। ক্রেতাদের মাত্র ৪৪ শতাংশ ঋণপত্র ব্যবহারের প্রস্তাব দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই নমনীয়তা প্রত্যাশা করেন তারা। আমাদের অনেক প্রতিযোগী দেশও বাণিজ্যের সহজ বাণিজ্য শর্ত অনুমোদন দিচ্ছেন, এ প্রেক্ষাপটে আমাদেরও মেনে নিতে হচ্ছে।
করোনার প্রভাবে দেশের তৈরি পোশাক খাত প্রাথমিকভাবে কাঁচামালের সরবরাহ সংকটে পড়ে। দেশে তৈরি পোশাক খাতের ওভেন পণ্যের আনুমানিক ৬০ শতাংশ কাপড় আমদানি হয় চীন থেকে। আর নিট পণ্যের কাঁচামাল আমদানি হয় ১৫-২০ শতাংশ। নভেল করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের কারণে চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হয়। পরবর্তী সময়ে কাঁচামাল সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও রফতানি গন্তব্যগুলোয় এ রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ায় চাহিদার সংকট তৈরি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত করতে থাকে একের পর এক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান।
সূত্রমতে, কভিডের প্রথম ঢেউয়ে ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত করা ক্রেতাদের মধ্যে ছিল প্রাইমার্কের মতো বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানও। আয়ারল্যান্ডভিত্তিক প্রাইমার্কের পাশাপাশি ছোট-মাঝারি-বড় সব ধরনের ক্রেতাই ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছিল ওই সময়।
পরে আবার এইচঅ্যান্ডএম, ইন্ডিটেক্স, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, কিয়াবি, টার্গেট, পিভিএইচসহ আরো কিছু ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ক্রয়াদেশ বহালও করে। এখন কভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে ক্রেতারা ক্রয়াদেশ সরবরাহের সময়ে বড় ধরনের পরিবর্তন শুরু করেছেন।
বিজিএমইএর তথ্য বলছে, এপ্রিল শেষে ১ হাজার ১৫০ কারখানার মোট ৩১৮ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়। এসব ক্রয়াদেশের আওতায় ছিল ৯৮ কোটি ২০ লাখ পিস পোশাক। অন্যদিকে এসব কারখানার কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ২২ লাখ ৮০ হাজার। এখন কভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে আবারো ক্রয়াদেশ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে এরই মধ্যে ক্রয়াদেশ ৩০ শতাংশ কমেছে বলেও জানিয়েছে বিজিএমইএ। এ পরিস্থিতিতে যে ক্রয়াদেশগুলো আসছে তার বেশির ভাগই ঋণপত্র ছাড়া। আর পশ্চিমা খুচরা বাজারের অনিশ্চয়তায় পণ্যের দাম পরিশোধ নিয়েও ঝুঁকি বাড়ছে। এরই মধ্যে উপকরণ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত পণ্যের মূল্য হিসেবে ক্রেতাদের কাছে ৮ বিলিয়ন ডলারের পাওনা সৃষ্টি হয়েছে। এ পাওনা আদায় নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন রফতানিকারকরা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক ড. শাহ মো. আহসান হাবিব বলেন, ক্রেতারা এখন রফতানির জন্য ঋণপত্র দিতে চাইছেন না। যদিও এটির ওপরই আমাদের বেশি নির্ভর করা উচিত। তারা ঋণপত্র দিতে চাচ্ছে না, কারণ এটা এক ধরনের প্রতিশ্রুতি, যেখানে ব্যাংকও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কভিডের সময় সময়মতো শিপমেন্ট না হওয়ার মতো ঝুঁকি থাকে। ফলে ঋণপত্র ব্যবহারে ঝুঁকি তুলনামূলক কম। সবকিছু ঠিক থাকলে ক্রেতা দাম পরিশোধে বাধ্য। কিন্তু ঋণপত্র ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতিতে রফতানিকারক সব শর্ত অনুসরণ করলেও আমদানিকারক দাম পরিশোধ নিয়ে গড়িমসি করতে পারেন। বাংলাদেশে ওপেন অ্যাকাউন্টের যে অনুমতি দেয়া হয়েছে, সেখানেও টাকা আসার গ্যারান্টি থাকতে হয়। শুধু নির্ভরযোগ্য ও সুনাম রয়েছে এমন ক্রেতাদের সঙ্গেই ঋণপত্র ছাড়া রফতানি কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে বলে মত দেন তিনি।