গুরুত্ব পাচ্ছে বৈশ্বিক উত্তোলন হ্রাস চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ চলতি বছরের মতো টালমাটাল পরিস্থিতির মুখোমুখি আগে কখনই হয়নি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার। করোনা মহামারীর মধ্যে বৈশ্বিক চাহিদায় রেকর্ড পতন, রাজনৈতিক বিবেচনায় সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যকার মূল্যযুদ্ধ—এমন নানা কারণে বছরের শুরু থেকে জ্বালানি পণ্যটির দাম টানা কমতির পথে ছিল। ইতিহাসে এবারই প্রথম জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি শূন্য ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। বছরের শেষ ভাগে এসে দাম কিছুটা বাড়লেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, জ্বালানি তেলের বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্য ফেরানো জরুরি। চাহিদা বৃদ্ধির সম্ভাবনা অনেকটাই নির্ভর করছে মহামারী পরিস্থিতির ওপর। আগামী দিনগুলোয় করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা বাড়তে পারে। নতুবা আরো কমবে। অন্যদিকে জ্বালানি পণ্যটির জোগান সীমিত করতে ভূমিকা রাখছে বৈশ্বিক উত্তোলন হ্রাস চুক্তি। জ্বালানি তেলের রফতানিকারকদের জোট অর্গানাইজেশন ফর দ্য পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজের (ওপেক) আওতায় এ চুক্তি হলেও রাশিয়াসহ জোটের বাইরের কয়েকটি দেশ চুক্তির শর্ত মেনে চলছে। বৈশ্বিকভাবে এ মিত্রতা ওপেক প্লাস নামে পরিচিত।
ওপেক প্লাসের আওতায় এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। মেয়াদ শেষে জ্বালানি পণ্যটির উত্তোলন সীমিত রাখার ব্যাপারে চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর বাধ্যবাধকতা থাকবে না। ফলে যেকোনো দেশ চাইলে ইচ্ছামতো অপরিশোধিত জ্বালানি তেল উত্তোলন করতে পারবে। এতে আগামী দিনগুলোয় জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা জ্বালানি পণ্যটির বাজারে নতুন করে চ্যালেঞ্জের জন্ম দিতে পারে।
এমন টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যেই বৈঠকে বসছে ওপেক প্লাস। ৩০ নভেম্বর ওপেক সদস্যদের ১৮০তম মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। পরদিন অর্থাৎ ১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে ওপেক-নন ওপেক দেশগুলোর ১২তম মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক। প্রতিবার এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায়। তবে এবার করোনা মহামারীর কারণে দুটো বৈঠকই অনলাইনে অনুষ্ঠিত হবে। স্বাভাবিকভাবেই এবারের বৈঠকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক উত্তোলন হ্রাস চুক্তির মেয়াদ আরো বাড়ানোর বিষয়টি।
ওপেকসংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক উত্তোলন হ্রাস চুক্তির মেয়াদ আরো তিন-ছয় মাসের জন্য বাড়ানোর বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হয়েছে ওপেক প্লাসের সদস্যরা। কেননা জোটভুক্ত দেশগুলো স্পষ্টতই করোনার চ্যালেঞ্জ উপলব্ধি করতে পারছে। তারা চায় না আগের পরিস্থিতিতে ফিরে যাক জ্বালানি তেলের বাজার। গত এপ্রিলের মতো আর কখনই শূন্য ডলারের নিচে জ্বালানি তেলের দাম নামুক, এটা কারোরই কাম্য নয়। তাই ওপেক প্লাসের সামনে বিদ্যমান চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর বিকল্প আপাতত নেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রাপ্যতার বিষয়টি এ মুহূর্তে জ্বালানি তেলের বাজারে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, কভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিয়ে অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্না, ফাইজার, বায়োএনটেকের মতো ওষুধ নির্মাতা কোম্পানিগুলোর যেকোনো সুখবর জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। এসব খবরে খাতসংশ্লিষ্টদের মনে আশা জাগছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন পেলে এবার বুঝি মহামারীর লাগাম টানা সম্ভব হবে। ফলে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা বাড়বে। ঊর্ধ্বমুখী হবে দাম।
কভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিয়ে এমন আশাবাদের সময়ে ওপেক প্লাসের বৈঠক থেকে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক উত্তোলন হ্রাস চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা এলে স্বাভাবিকভাবে জ্বালানি পণ্যটির বাজার পরিস্থিতি আরো চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে। অন্তত আগামী বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিক কিংবা এপ্রিল-জুন প্রান্তিক পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তির পথে থাকতে পারে জ্বালানি পণ্যটির দাম। তাই বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, ওপেক প্লাস এ সুযোগ কাজে লাগাবে। জ্বালানি তেলের বাজারে চাহিদা পতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরবরাহ সীমিত করে আনবে। এর মধ্য দিয়ে করোনাকালে আর্থিক লোকসানের ঝুঁকি কিছুটা হলেও লাঘব হবে চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর।
এর পরও চ্যালেঞ্জ রয়ে যাচ্ছে। গত মার্চে ওপেক প্লাসের বৈঠকে সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যে এ চুক্তি নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। বৈঠকের পর পরই জ্বালানি তেলের বাজারে মূল্যযুদ্ধে জড়ায় দেশ দুটি। এর ফলাফল বিশ্ববাসী দেখেছে। করোনা মহামারীর মধ্যে মূল্যযুদ্ধের জের ধরে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম শূন্য ডলারের নিচে নেমে যায়। অর্থাৎ ওই সময় জ্বালানি তেল কিনলে ক্রেতাকে দাম পরিশোধ করতে হয়নি। উল্টো বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান পরিবহন ব্যয় জোগান দিয়েছে।
ওপেক প্লাসের এবারের বৈঠকে মতবিরোধ দেখা দিলে জ্বালানি তেলের বাজারে নতুন করে আগের সেই পরিস্থিতি ফিরে আসার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। যদিও এটা কারোরই কাম্য নয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) পক্ষ থেকে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর বিরুদ্ধে প্রস্তাব উত্থাপনের সম্ভবনা রয়েছে। রাজনৈতিক কারণে বেঁকে বসতে পারে ইরানও। কেননা ওপেকের বৈঠকের প্রাক্কালে দেশটির শীর্ষ পরমাণু পদার্থবিদ মোহসেন ফাখিরজাদকে হত্যা করা হয়েছে। এর প্রভাব পড়তে পারে ওপেক প্লাসের এবারের বৈঠকে।
রয়টার্স, অয়েলপ্রাইসডটকম ও ব্লুমবার্গ অবলম্বনে