উপনির্বাচনেও ভোটের হারে বিস্ময়

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ এবারে ঢাকা ও সিরাজগঞ্জের উপনির্বাচনেও বিস্ময়কর ফল হয়েছে। সিরাজগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তানভীর শাকিল জয় পেয়েছেন ১ লাখ ৮৮ হাজার ৩২৫ ভোট। তার বিপরীতে বিএনপি প্রার্থী সেলিম রেজা পেয়েছেন ৪৬৮ ভোট। আর ঢাকায় ভোট-বিমুখ মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ঢাকা-১৮ আসনে ৮৫.৮২ শতাংশ মানুষ ভোট দেননি। এ আসনে ভোট পড়েছে মাত্র ১৪.১৮ শতাংশ। তারপরও আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোহাম্মদ হাবিব হাসান পেয়েছেন ৭৫ হাজার ৮২০ ভোট। বিএনপির প্রার্থী এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন পেয়েছেন ৫ হাজার ৩৬৯ ভোট। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দুই উপনির্বাচনের ফল ও ব্যবধান বিস্ময়কর। এটা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। দিন দিন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। নির্বাচন কমিশন এবং ভোটদান প্রক্রিয়ার ওপরও ভোটারদের আস্থা নেই। এ ছাড়া নির্বাচনে যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকার কারণেই বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম। রাজনৈতিক নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা, জনবিচ্ছিন্নতার কারণেও ভোট কেন্দ্রে ভোটার যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক গতকাল বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর মানুষের আস্থা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এই কমে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিষ্ক্রিয়তাই দায়ী। তারা যদি সক্রিয় হয়ে নির্বাচনে মানুষকে ডেকে আনতেন। তবে এমন হতো না। তিনি বলেন, মানুষের ভোটের প্রতি আগ্রহ থাকবে কেন? মানুষের লাভটা কী? যদি প্রার্থীরা ভোটারদের একটু সম্মান দেখিয়ে নিয়ে যেতেন, তবে হয়তো ভোটারা ভোট কেন্দ্রে যেতেন। তা না হলে কেন তারা ভোট কেন্দ্রে যাবেন? সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, এখন যে ভোট কাস্টিংয়ের হার কম হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যারা সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন। তারা তো তাদের ভোটারদের আনার কথা? একটি এলাকায় যদি ৩ লাখ ভোটার থাকেন, তবে প্রার্থী অন্তত ১ লাখ ভোটার তো আনবেন। তাহলেও তো ৩৩ ভাগ ভোট হয়। সারা দেশে আওয়ামী লীগের ৩০-৪০ ভাগ ভোট আছে। বিএনপিরও ২০-৩০ ভাগ ভোট আছে। বিএনপিরগুলো না হয় এলো না। তারা রাগ করে থাকল। আওয়ামী লীগের প্রার্থী তার ভোটারদের আনে না কেন? এটা তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না? তিনি যদি উদাসীন হয়ে যান, যে বিনা ভোটেই তো জয়ী হয়ে গেলাম। এ জন্য দল থেকে অনুশাসন দেওয়া দরকার। তারা তো এখনো মিটিং করলে ট্রাকে ট্রাকে লোক আনেন। তো ট্রাকে ট্রাকে ভোটার আনতে পারলেন না? এ জন্য নির্বাচন কমিশনের দায় আছে কিনা- প্রশ্নে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো ভোটের আয়োজন করা। এ বিষয়ে সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, সিরাজগঞ্জে ভোটের যে ব্যবধান। শুধু বিস্ময়কর নয়, এটা আমাদের জন্য আশঙ্কার বিষয়। এটা যদি সত্য হয় তবে আমাদের দেশে কোনো বিরোধী দল নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া যেমন গণতন্ত্র হয় না। তেমনি বিরোধী দল ছাড়াও গণতন্ত্র হয় না। এটা আমাদের জন্য অশনি সংকেত। আর যদি এটা (ফল) মিথ্যা হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশন যে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এটা তার প্রমাণ। তিনি বলেন, মানুষের নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্যই মানুষ ভোট দিতে ভোট কেন্দ্রে যাচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনের যে ধরনের ভূমিকা পালন করার কথা- ‘যে কোনো মানুষ কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষভাবে ভোট দিতে পারবেন।’ কিন্তু নির্বাচন কমিশন তা নিশ্চিত করতে পারেনি। ভোটের ওপর যে আস্থাহীনতা, তা মূলত নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থাহীনতা। এ জন্যই মানুষ ভোট দিতে কেন্দ্রে যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এ দেশের মানুষ ভোটপাগল। কিন্তু এমন অবস্থা হয়েছে যে, মানুষ ভোট দিতে গিয়ে ভোট দিতে পারবে না। ভোট দিলেও সঠিকভাবে গণনা হবে না। ভোট দিলেও কিছু আসে যায় না। এমন সন্দেহ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছে।
অন্যদিকে গত ১৭ অক্টোবর ঢাকা-৫ আসনে নির্বাচনে ৪ লাখ ৭১ হাজার ৭১ ভোটের মধ্যে মাত্র ৪৯ হাজার ১৪১ ভোট পড়েছে। ভোট প্রদানের হার মাত্র ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এ নির্বাচনে ৪৫ হাজার ৬৪২ ভোট পান আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজী মনিরুল ইসলাম মনু। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহম্মেদ পান ২ হাজার ৯২৬ ভোট। এ ছাড়া দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে ২১ মার্চ ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই আসনের ভোটসংখ্যা ৩ লাখ ২১ হাজার ২৭৫। ভোট পড়ে মাত্র ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ১৫ হাজার ৯৯৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। বিএনপির প্রার্থী শেখ রবিউল আলম ধানের শীষ প্রতীকে পান ৮১৭ ভোট এবং জাতীয় প্রার্থীর হাজী মো. শাহজাহান ৯৭ ভোট পান। করোনা সংক্রমণের আগে এ বছর ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম-৮ উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইভিএমে অনুষ্ঠিত ওই ভোটে ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৪৮৫ ভোটের মধ্যে ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ কাস্ট হয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো কম ছিল।
ঢাকায় ভোট পড়েছে ১৪.১৮ ভাগ : ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ১৪.১৮ শতাংশ। ঢাকা-১৮ আসনে উপনির্বাচনে ২১৭টি কেন্দ্রের ফলাফলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হাবিব হাসান ৭৫ হাজার ৮২০ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন পেয়েছেন ৫ হাজার ৩৬৯ ভোট। গণফ্রন্টের কাজী মো. শহীদুল্লাহ ১২৬ ভোট, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. ওমর ফারুক ৯১ ভোট এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের মো. মহিবুল্লাহ বাহার পেয়েছেন ৮৭ ভোট। এ আসনের ৫ লাখ ৭৭ হাজার ১১৬ ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৮১ হাজার ৮১৮ ভোট। সিরাজগঞ্জে ভোট পড়েছে ৫১.৭৫ শতাংশ : সিরাজগঞ্জ-১ (কাজীপুর-সিরাজগঞ্জ সদরের একাংশ) আসনের উপনির্বাচনে প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তানভীর শাকিল জয় বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন। জয় ভোট পেয়েছেন ১ লাখ ৮৮ হাজার ৩২৫। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী সেলিম রেজা ভোট পেয়েছেন ৪৬৮টি। আসনটিতে মোট ভোট পড়েছে ৫১.৭৫ শতাংশ।