সংবাদপত্র ও জেমস অগাস্টস হিকি

0
পাভেল চৌধুরী
সংবাদপত্র ছাড়া আধুনিক জীবনের কথা কল্পনা করা যায় না। আধুনিক মানুষের প্রাতঃসাথি সংবাদপত্র। সংবাদপত্রে চোখ না রাখতে পারলে দিনের শুরুটাই যেন অপূর্ণ থেকে যায়। যে কারণে যত দিন যাচ্ছে সংবাদপত্রের প্রভাব প্রসার তত বাড়ছে, যেন একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে মানুষের সাথে সংবাদপত্রের। যদিও এই সংবাদপত্র যে খুব প্রাচীন বিষয় তা কিন্তু না। ১৭০৯ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম নিয়মিত সংবাদপত্র প্রকাশ হতে শুরু করে। অবশ্য ষোড়শ শতকেও ইউরোপের কোনো কোনো দেশে সংবাদপত্র প্রকাশের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। আসলে সংবাদপত্রের ইতিহাস মুদ্রণযন্ত্রের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার ছাড়া সংবাদপত্রের প্রকাশ সম্ভব ছিল না। হালে বিশ^ব্যাপী যে ইন্টারনেটের প্রসার হলো তাতে সংবাদপত্রের প্রচার ও প্রসার যে কিছুটা হোঁচট খায়নি এমন না কিন্তু যতটা আশক্সক্ষা করা হয়েছিল ততটা না। সংবাদপত্রের আবেদন হচ্ছে বহুমুখী, শুধু সংবাদ পরিবেশনই না; সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির প্রচার প্রসারও সংবাদপত্রের অন্যতম লক্ষ্য।
সাধারণভাবে বলা হয় বাংলায় প্রথম প্রকাশিত সংবাদপত্র ছিল সমাচার দর্পণ। শ্রীরামপুরের ব্যপিষ্ট মিশন সোসাইটি থেকে এটা প্রকাশিত হত। সাপ্তহিক। ২৩ মে ১৮১৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। দাম; মাসিক ১ রুপি। মধ্যে সপ্তাহে ২ দিন, শনি আর বুধবারে প্রকাশিত হত, দাম দেড়রুপি মাসিক। ১৮২৯ সাল থেকে ইংরেজি বাংলা দুই ভাষাতেই পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। সম্পাদক র্ছিলেন জন কার্ক মার্শম্যান। প্রচার সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০০, তখনকার হিসেবে ভালই বলতে হবে। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বরে পত্রিকাটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল সম্পাদকের স্বাস্থ্যের অবনতি, কর্ম ব্যস্ততা। পত্রিকার জন্য যথেষ্ট সময় দিতে পারছিলেন না তিনি। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো যে উদ্দেশ্যে পত্রিকাটা প্রকাশ করা হয়েছিল খ্রিষ্ট ধর্মের প্রচার, সেই উদ্দেশ্য তেমন ফলপ্রসূ হচ্ছিল না। মধ্যে রামমোহনের সাথে এক ধর্মীয় বাহাস পত্রিকাটিকে বিতর্কিত করেছিল।
কেউ কেউ অবশ্য দাবি করেন গঙ্গা কিশোর ভট্টচার্য সম্পাদিত ‘বেঙ্গল গেজেটি’ সমাচার দর্পণের আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। বেঙ্গল গেজেটির কোনো কপি পাওয়া যায় না। ১১/৫/১৮১৮, ০১/০৭/১৮১৮ সালে প্রকাশিত ২টা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই পত্রিকা সম্পর্কে জানা যায়। সম্ভবত ১ বছর চলেছিল পত্রিকাটা, মাসে ২রুপি ছিল গ্রাহক চাঁদা। গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য ছিলেন শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের কম্পোজিটর। কলকাতায় এসে ১৮১৬ সালে ফেরিস এ- কোম্পানির প্রেস থেকে তিনি সচিত্র বাংলা বই ‘অন্নদামঙ্গল’ প্রকাশ করেন। এটাই ছিল প্রথম সচিত্র বাংলা বই। কলকাতা শহরে দোকান খুলে বইয়ের ব্যবস্াও তিনি প্রথম শুরু করেন। ১৮১৮ সালে তিনি নিজেই ‘বেঙ্গল গেজেটি প্রেস’ নামে একটা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বেঙ্গল গেজেটি পত্রিকা। এরপর কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাসে সেসব পত্রিকার বিশিষ্ট ভূমিকাও আছে। আঠারো শতকের বিশ/ত্রিশের দশকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত অন্যতম পত্রিকা সমূহ ছিল; ইংরেজি দৈনিকঃ বেঙ্গল হরকরা, ক্রানিকল, কলিকাতা গেজেট; সাপ্তাহিকঃ বেঙ্গল হেরাল্ড, লিটেরারী গেজেট, ওরিয়েন্টাল অবজর্বর; বাংলা সাপ্তাহিকঃ বঙ্গদূত, সমাচার চন্দ্রিকা, সম্বাদ কৌমুদি ইত্যাদি। মজার ব্যাপার সাপ্তাহিক দ্রব্যমূল্যের পত্রিকাও প্রকাশিত হত; কলিকাতা এক্সচেজ্ঞ প্রাইস কারেন্ট, কলিকাতা উইকলি প্রাইস কারেন্ট, ডোমেস্টিক রিটেল প্রাইস কারেন্ট, ইত্যাদি।
প্রশ্ন হলো বিশাল এই ভারতবর্ষে সর্ব প্রথম কে কোথা থেকে সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিল? জেনে অবাকই হতে হয় শুধু ভারতবর্ষ না, গোটা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে। পত্রিকার নাম ছিল ‘বেঙ্গল গেজেট’। প্রতি শনিবার পত্রিকাটা প্রকাশিত হত। প্রকাশক ছিলেন জেমস অগাস্টস হিকি।
হিকির পত্রিকা প্রকাশের ১২ বছর আগে জনৈক ডাচ উদ্যোক্তা উলিয়াম বেন্টিস ভারত থেকে পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। জেমস হিকির জীবন কাহিনী খুবই বিচিত্র। ১৭৪০সালে আয়ারল্যান্ডে তার জন্ম। লন্ডনে তিনি মুদ্রাকর উইলিয়াম ফেডেনের সংস্পর্শে আসেন এবং মুদ্রাযন্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তারপর তিনি ব্রিটিশ আইনজীবী সার্জেন্ট ডেবির অধীনে চাকরি নেন।
১৭৭২ সালে হিকি কলকাতায় আসেন। তখন তিনি একজন চিকিৎসক আবার সমুদ্র উপকূলে ব্যবসাও করছেন। এক সময় বিপুল পরিমাণ দায় দেনায় জড়িয়ে পড়েন তিনি, যার পরিণতিতে ১৭৭৬ সালে তাকে জেলে যেতে হয়। আর জেলখানা থেকেই ২০০০ রুপি দিয়ে তিনি একটা ছাপার যন্ত্র জোগাড় করেন। শোনা যায় জেলে বসে তিনি ছাপার অক্ষরও তৈরি করতেন। জেলখানা থেকে তিনি শুরু করেন ছাপার ব্যবসা। মূলত ফোর্ট উইলিয়মের নথিপত্রই তিনি ছাপতেন। ১৭৭৮ সালে তিনি তার পক্ষে ব্রিটিশ আইনজীবী এটর্নি উইলিয়ম হিকিকে নিযুক্ত করেন এবং জেল থেকে মুক্তি পান।
জেমস অগাস্টস হিকি ছিলেন খুব চড়া মেজাজের লোক। এটর্নি উইলিয়ম হিকির স্মৃতি কথা থেকে হিকির যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় তিনি ছিলেন উৎকেন্দ্রিক জেদি ধরনের, বেপরোয়াও।
২৯ জানুয়ারী ১৭৮০ সাল থেকে বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ হতে শুরু করে। ঠিকানা; ৬৭, রাধাবাজার, কলকাতা, ভারত। পত্রিকাটির ঘোষণা ছিল ‘সকলের জন্য উন্মুক্ত, কারো দ্বারা প্রভাবিত নয়’ (ড়ঢ়বহ ঃড় ধষষ রহভষঁবহপবফ নু হড়হব)। ধনি গরীবের বৈষম্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির সম্প্রসারণ নীতি, কর বৃদ্ধির মাধ্যমে শোষণ, পদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, এসবের বিরূদ্ধে বেঙ্গল গেজেট ছিল সোচ্চার। পত্রিকা চলছিল ভালই। সেই আমলে ৪০০ কপি ছাপা হত। পত্রিকা থেকে আয়ও খারাপ ছিল না কিন্তু জেমস হিকি এমন সব খবর পত্রিকায় পরিবেশন করতেন যাতে প্রায় সবসময়ই তাকে মানহানির মামলা মোকাবেলা করতে হত। এর মধ্যে হিকির জন্য একটা অসুখকর ঘটনা ঘটলো। তিনি জানতে পারলেন যে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জনৈক কর্মকর্তা তার কাগজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ নামে একটা পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। ক্ষুদ্ধ হলেন তিনি। অভিযোগ করলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাইমন ডুজ এবং গভর্ণর জেনারেলের পতিœ মেরিনা হেস্টিংস তার কাছে ঘুষ চেয়েছে।
মেরিনা হেস্টিংস ছিলেন খুবই উন্নাসিক ধরনের মহিলা; কেতাদুরস্ত, কর্তৃত্বপরায়ণাও। হেস্টিংসের পত্মি হিসেবে তিনি ছিলেন যথেষ্ট ক্ষমতাধর কিন্তু কলকাতায় বসবাসরত ইউরোপিয় মহিলা মহলে তার তেমন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। আর ওয়ারেন হেস্টিংস ফোর্ট উইলিয়াম রেসিডেন্সের প্রথম গভর্ণর জেনারেল, তার দৌরাত্ম ছিল সর্বজন বিদিত। হেস্টংসের সুপ্রিম কোর্ট কাউন্সিল হিকির পরিবেশিত খবরে প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ হয়েছিল এবং পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে কাগজ বিতরণ বন্ধ ঘোষণা করেছিল কিন্তু তাতে হিকি নিরস্ত হলো না। স্বয়ং হেস্টিংসের বিরুদ্ধে তিনি এবার মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, দুর্নীতি, আর দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগ আনলেন। শুধু গভর্ণর জেনারেল হেস্টিংস না, অন্যান্য বৃটিশ কর্মকর্তারাও এই অভিযোগ থেকে বাদ পড়লো না। অভিযোগের তালিকায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পে এবং প্রটেষ্টান্ট মিশনের নেতা জোহান জাকারিয়াস কারমেনজাবও যোগ হলো। হেস্টিংস আর কারমেনজারস সুপ্রিম কোর্টে হিকির বিরুদ্ধে ৩টে মানহনির মামলা করলেন। সুপ্রিম কোর্ট মনোনিত ১২জন জুরির নানা রকম বিচার বিবেচনায় ৩টে মামলাতেই নির্দোষ ঘোষিত হলো হিকি। কিন্তু জুরিদের এই রায়ে অনাস্থা জানালো সুপ্রিম কোর্ট। অতঃপর পুণরায় নতুন করে জুরি মনোনিত করা হলো এবং ৪ দিনের শুনানি শেষে ৩টে মামলাতেই দোষী সাব্যস্ত করা হলো হিকিকে। ১৭৮১ সালে আবার তাকে জেলে যেতে হলো।
কিন্তু হিকি দমবার পাত্র ছিলেন না। জেল থেকেই তিনি তার সংবাদপত্র প্রকাশনার কাজ অব্যাহত রাখলেন এবং যথারীতি হেস্টিংস ও অন্যান্য বৃটিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ করতে লাগলেন। হেস্টিংস নতুন করে হিকির বিরুদ্ধে কেস সাজালো এবং ৩০ মার্চ ১৭৮২ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে হিকির প্রেস বন্ধ করে দেওয়া হলো।
১৭৮৪ সালে জেমস অগাস্টস হিকি জেল থেকে মুক্তি পান। এবারও তার আইনজীবী ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের এটর্নি উইলিয়াম হিকি। উইলিয়াম হিকি ছিলেন ব্রিটিশ অভিজাত শ্রেণির মানুষ। তার সাথে জেমস হিকির সামাজিক অবস্থার তুলনা হয় না। জেমস হিকির আচরণে একাধিকবার তিনি চরম বিরক্ত হয়েছেন, মামলা চালাতে অস্বীকৃতিও জানিয়েছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বিমুখ করতে পারেননি। জেমস হিকিকে তিনি প্রতিভাবান মনে করতেন। সেই সাথে মনে করতেন উচ্ছৃঙ্খল, অপরিণামদর্শীও। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর জেমস অগস্টাস হিকি সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। তবে ৩ বছর জেলে থাকায় তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল আর সীমাহীন দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েছিলেন তিনি। ১৮০২ সালে চীনের পথে এক নৌযানে তার মৃত্যু হয়। জেমস অগাস্টস হিকির কোনো ছবি পাওয়া যায় না তবে পৃথিবীর বিখ্যাত কিছু সংগ্রহশালায় বেঙ্গল গেজেটের কয়েকটা পাতা আর হিকির স্বাক্ষর সংরক্ষিত আছে। আমরা অবশ্যই জেমস অগাস্টস হিকির প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো, কলকাতা থেকে এশিয়া মহাদেশের প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন বলে শুধু না, তিনি পরাক্রম ব্রিটিশ অভিজাত শাসকদের অন্যায় কার্মকান্ডের বিরুদ্ধে অসীম সাহসিকতায় কলম ধরেছিলেন, সমাজ বিকাশের ধারায় সেটা অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে সন্দেহ নেই।