এখনও জোয়ার-ভাটায় দিন কাটছে আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের

0

সাতক্ষীরা সংবাদদাতা॥ ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পাঁচ মাস পরেও দুর্ভোগ কাটিয়ে উঠতে পারেনি সাতক্ষীরার আশাশুনি সদর, শ্রীউলা ও প্রতাপনগর ইউনিয়নের মানুষ। এখনও ৫০ হাজারের বেশি মানুষ নিয়মিত জোয়ার-ভাটার মধ্যে বসবাস করছে। আশাশুনি উপজেলা প্রশাসনের তথ্যনুযায়ী ১০ হাজার পরিবারের ৫০ হাজার মানুষ এখনও পানিবন্দি। জানা যায়, গত ২০ মে রাতে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হাতে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। আম্পানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধগুলো। আম্পানের ৫ মাস পেরিয়ে গেলেও সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার তিন ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি বেড়িবাঁধ মেরামত করা সম্ভব হয়নি। ফলে এখনও মানুষের বাড়ির উঠানে চলছে জোয়ার-ভাটার খেলা। ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। এতে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে উপজেলার বিশাল জনগোষ্ঠী। বাঁধ ভেঙে পানির আধারগুলো নষ্ট হওয়ায় সুপেয় পানির জন্যও চলছে হাহাকার।
আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়ন, শ্রীউলা ইউনিয়ন এবং সদরের দয়ারঘাট এলাকার ৫০ হাজারের বেশি মানুষ এখনও পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছেন। সবচেয়ে সমস্যায় আছে শিশু, নারী এবং বৃদ্ধরা। নারীদের বাথরুম করার জন্য সন্ধ্যা বা অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাহুনিয়ার ওহাব আলী বলেন, ‘আম্পানের পর আজ পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে আমরা জোয়ার-ভাটার মধ্যে বসবাস করছি। কেউ আমাদের খোঁজ রাখেনি। ঝড়ের পর অনেকে এসে দেখে গেছে, অনেক কিছু বলেছে, কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। আমাদের দুঃখ কষ্ট আমাদের ভিতরে রাখতে চাই। খাওয়ার পানির খুব কষ্ট আমাদের। গোসল করতে পারছি না, বাথরুম করতে পারছি না। বিভিন্ন সংস্থা থেকে যে খাওয়ার পানি দিচ্ছে তা খেয়েই শেষ। দেখা দিচ্ছে নানান পানিবাহিত রোগ।’
শ্রীউলা ইউনিয়নের কলিমা গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান হাবিব বলেন, ‘আম্পানের পাঁচ মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের দিকে কারও নজর নেই। হাজরাখালি, মাড়িয়ালা, কলিমাখালি কোল হিলাজিয়া লাঙ্গলদাড়িয়া নাসিমাবাদসহ বেশ কয়টি গ্রামের ২৫ হাজার মানুষ এখনও জেয়ার-ভাটার মধ্যে বসবাস করছে। এসব এলাকায় রাস্তা-ঘাট কিছুই নেই। খাওয়ার কষ্ট, পানির কষ্ট। শুধু মানুষ নয়, গরু-ছাগলসহ গবাদিপশুরাও কষ্টে আছে।’ প্রতাপনগরে ইউনিয়নের মিলন বিশ্বাস বলেন, ‘আম্পানের পর পাঁচ মাস পানিতে ডুবে আছে এখানকার ১৮ গ্রাম। রিং বাঁধের মাধ্যমে কয়েকটি পয়েন্টে পানি আটকানো গেলেও কুড়িকাহুনিয়া, হরিষখালী ভাঙন দুটিতে পানি আটকানো যায়নি। সে কারণে এখনও কুড়িকাহুনিয়া, হরিষখালী, শ্রীপুর সনাতনকাটি, গোয়ালকাটি, প্রতাপনগর, নাকনা, কল্যাণপুর, মান্দারবাড়িয়ার মানুষের দুর্ভোগ এখনও কমেনি। এসব এলাকার মানুষ জোয়ার-ভাটার মধ্যে বসবাস করছে।’ আশাশুনির শ্রীউলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিল বলেন, ‘আম্পানের ৫ মাস পরও আজও ইউনিয়নের অনেক মানুষ পানির মধ্যে বসবাস করছে। আমাদের দুর্ভোগ আজও কমেনি।’
একই অভিযোগ প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের। তিনি বলেন, ‘পাঁচ মাস ধরে মানুষ পানির মধ্যে বসবাস করছে। এটা কোনও জীবন নয়। আমাদের কষ্টের সীমা নেই। আম্পানের পর বাঁধ বাধার পর, দুইবার বাঁধ ভেঙে পুরো ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে ঘরবাড়ি, মৎস্য ঘের প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মানুষ কীভাবে পারবে? একটা ক্ষত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার আঘাত।’ তিনি আরও বলেন, ইউনিয়নের আট হাজার ১১৮ পরিবার এখনও জোয়ার-ভাটার মধ্যে বসবাস করছে। আম্পানের পাঁচ মাস পরেও হরিষখালী ও কুড়িকাহুনিয়, চাকলার বাঁধ দেওয়া যায়নি। ইউনিয়নের চলাচলের সব রাস্তা নষ্ট হয়েছে। আম্পানের পর থেকে দুর্ভোগ কমেনি। নৌকায় চলাচল করতে। হরিষখালীতে ঠিাকাদার কাজ করছে কিন্তু কাজে খুবই ধীরগতি। শুনেছি নভেম্বর শুরু থেকে সেনাবাহিনী আবারও কাজ শুরু করবে। এবার বাঁধ দিতে না পারলে আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মীর আলিফ রেজা বলেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়ন এবং আশাশুনির সদরের কিছু অংশ। তবে আগের তুলনায় পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। উপজেলার ১০ হাজার পরিবার এখনও পানিবন্দি। তিনি আরও বলেন, প্রতাপনগরের চাকলা, শুভদ্রাকাটি, কুড়িকাহুনিয়া, কোলা, হরিষখালি, হিজলাসহ ৬টি পয়েন্ট ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় রিং বাঁধ দেওয়া হলেও কিছু এলাকায় পানির প্রবল চাপে বাঁধ দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রবল জোয়ারের কারণে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাঁধ নির্মাণে কাজ করতে পারেননি। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সেনাবাহিনী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে স্থায়ী বাঁধের কাজ শুরু করবে। আশা করছি এসব এলাকার মানুষের দুর্দশা দ্রুত লাঘব হবে। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার বলেন, আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরা উপকূলের অনেক এলাকায় রিং বাঁধ দেওয়া গেলেও আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরের কুড়িকাহুনিয়া, হরিষখালী, চাকলা, শ্রীউলা ইউনিয়নের হাজরাখালি এবং আশাশুনির সদরের দয়ারঘাট এলাকায় প্রবল জোয়ারে ৩০-৪০ ফুট গভীর খাল সৃষ্টি হওয়ায় ১২৯০ মিটার বাঁধ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। পরে কয়েকটি পয়েন্টে বাঁধ এবং রিং বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে হাজরাখালি এবং কুড়িকাহুনিয়া পয়েন্টে সেনাবাহিনী খুব দ্রুত কাজ শুরু করবে। আমাদেরও কিছু শেষ হয়েছে এবং কিছু কাজ চলমান আছে। এসব পয়েন্টে বাঁধ দেওয়ার পর লোকালয়ে পানি প্রবেশ বন্ধ হবে বলে জানান তিনি।