যশোরে মধ্যরাতে বিএনপি নেতাদের বাড়িতে তাণ্ডব

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যশোর সদর উপজেলা উপনির্বাচনের তিন দিন আগে শনিবার গভীর রাতে বিএনপির কার্যালয় ও জেলার শীর্ষ নেতাদের বাড়িতে তাণ্ডব চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। আগামীকাল মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) অনুষ্ঠেয় সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে বিএনপি অভিযোগ করছে। একাধিক প্রাইভেটকার, একটি অ্যাম্বুলেন্স ও কুড়ির অধিক মোটরসাইকেল নিয়ে মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে দুর্বৃত্তদল নির্বিঘেœ চালিয়েছে তাণ্ডব। পরিবারের শিশু ও নারীদের আতংকের মুখে নেতারা পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়েও পাননি। রাতে যারা ফোনে পেয়েছেন তাদের দায়সারা জবাব দিয়েছেন কোতয়ালি থানার ওসি। ভাঙচুরের পাশাপাশি এ সময় অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে তারা। হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে নেতাদের। দলীয় কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসীরা তছনছ, ধানের শীষের প্রার্থীর নির্বাচনী সরঞ্জাম লুট ও জেলা যুবদলের প্রচার সম্পাদক এস্কেন্দার আলী জনির বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যার চেষ্টা চালায়।
অপরদিকে দলীয় কার্যালয় ও নেতৃবৃন্দের বাড়িতে নির্বাচন প্রাক্কালে ক্ষমতাসীন দলের তান্ডবের ঘটনার প্রতিকার ও নিরাপত্তা চেয়ে রোববার দুপুরে পুলিশ প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বিএনপি নেতৃবৃন্দ। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছেও লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে।  জেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব অ্যাড. সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু জানান, শনিবার দিবাগত রাত সোয়া ২ টার দিকে উপশহরস্থ ডি-ব্লকে তার বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। গাড়ো সবুজ রঙের ও সাদা রঙের দুটি প্রাইভেটকার এবং অন্তত ১০টি মোটরসাইকেলে করে ২৫-৩০ জন এসে সন্ত্রাসীরা তার বাড়িতে হামলা চালায়। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজের পাশাপাশি তার বাড়িতে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। এতে তার বাড়ির জানালাসহ সকল স্থানের গ্লাস ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। বাড়ির গেটও ভাঙচুর করা হয়। ঘটনার সময় তিনি বাড়িতেই ছিলেন। কিন্তু সন্ত্রাসীদের আচমকা হামলায় তিনিসহ পরিবারের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। সাহায্য পেতে কোতয়ালি থানা পুলিশের ওসিকে তিনি এ সময় বারবার মোবাইল ফোন দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। তিনি আরও জানান, তার বাড়িতে হামলার পর কিছুদূরে ডি-ব্লকের বাসিন্দা জেলা বিএনপি’র আহবায়ক কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান খানের বাড়িতে আক্রমণ করে একই সন্ত্রাসীরা। এরপর ঘোপ জেল রোড পিলু খান বাইলেনে বিএনপি’র জাতীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত তরিকুল ইসলামের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। জেলা বিএনপি’র আহবায়ক কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান খান জানান, সন্ত্রাসীরা তার বাড়ির গেটে প্রচন্ড ধাক্কাধাক্কি করে। এ সময় অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ওই সন্ত্রাসীরা।
সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত তরিকুল ইলামের সহধর্মিনী জেলা বিএনপি’র আহবায়ক অধ্যাপক নার্গিস বেগম জানান, সন্ত্রাসীরা তার বাড়ির গেট প্রচন্ড ধাক্কাধাক্কি করে, লাথি মারে। তারা গালিগালাজও করে। এ সময় চিৎকার চেঁচামেচি ও শব্দ শুনে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। তিনি আরও বলেন, প্রায় আধাঘণ্টা তান্ডব চালানোর পর সন্ত্রাসীরা সেখান থেকে চলে যায়। জেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহবায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকন জানান, প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলে করে আসা সন্ত্রাসীরা রাত আড়াইটার পরপরই তার ধর্মতলার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। সন্ত্রাসীরা তার নাম ধরে গালিগালাজ করে। তার ভাই মো. মুনির হোসেন খানের ৪ তলা ভবনে বৃষ্টির মতো পাথর ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে ভবনের বিভিন্ন স্থানের গ্লাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সন্ত্রাসীরা ওই ভবনে থাকা একটি সিসি ক্যামেরা খুলে নিয়ে গেছে। তিনি অভিযোগ করেন, তাৎক্ষণিক কোতয়ালি থানা পুলিশের ওসি’র কাছে ফোন করে তাকে হামলার বিষয়টি জানান। ওসি তাকে বলেছিলেন, ওই এলাকায় পুলিশের একটি টহল পার্টি আছে, তারা সেখানে যাচ্ছে। কিন্তু অভিযোগ করা সত্বেও পুলিশ তাদের বাড়িতে আসেনি। তিনি আরও জানান, একই সন্ত্রাসীরা নগর বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক মুনীর আহম্মেদ সিদ্দিকী বাচ্চু ও জেলা বিএনপি’র আহবায়ক কমিটির সম্মানিত সদস্য গোলাম রেজা দুলুর বাড়িতেও হামলা চালিয়েছে।
নগর বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক মুনীর আহম্মেদ সিদ্দিকী বাচ্চু জানান, গভীর রাতে সন্ত্রাসীরা তার বাড়িতে আক্রমণ করে। এ সময় তারা দরজা ধাক্কাধাক্কি ও গালিগালাজ করে। ফলে তিনিসহ পরিবারের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। পুলিশের সাহায্য পেতে এ সময় তিনি কোতয়ালি থানার ওসিকে ৩ দফা মোবাইল ফোন করেন। কিন্তু ওসি তার ফোন রিসিভ করেননি। জেলা বিএনপি’র আহবায়ক কমিটির সম্মানিত সদস্য গোলাম রেজা দুলু জানান, রাত ২টা ৪৮ মিনিটের দিকে সন্ত্রাসীরা কারবালা রোডে সরকারি মহিলা কলেজের পাশে তার বাড়িতে আচমকা আক্রমণ করে। দূর থেকে পায়ে হেঁটে এসে সন্ত্রাসীরা তার বাড়িতে হামলা করে। তারা বাইরে থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে তার বাড়ির বিভিন্ন স্থানের গ্লাস ভেঙে গেছে। ওই সন্ত্রাসীরা বাইরের বৈদ্যুুতিক বাল্ব ভাঙচুর করে। বাইরে থাকা ফুলের টবও ভেঙে ফেলেছে তারা। ফুলগাছ লাগানো টব বাইরে থেকে ভেতরে ছুঁড়ে মেরেছিলো সন্ত্রাসীরা। এ সময় গেটে ছিলেন নৈশ প্রহরী। কিন্তু সন্ত্রাসীদের বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপের কারণে নৈশ প্রহরী পালিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বাধ্য হন। গোলাম রেজা দুলু বলেন, তিনি ডাকাতরা হামলা চালিয়েছে ভেবে তাৎক্ষণিক নিজের লাইসেন্সকৃত পিস্তল দিয়ে ৪ রাউন্ড ফাঁকা গুলিবর্ষণ করেন। এর কয়েক মিনিট করে সন্ত্রাসীরা সেখান থেকে চলে যায়। তার ভবনে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ওই সন্ত্রাসীদের হামলার দৃশ্য ধরা পড়েছে। তিনি আরও জানান, আক্রমণের সাথে সাথে পুলিশকে ফোন করে তিনি বিষয়টি জানিয়েছিলেন। কিন্তু সন্ত্রাসীরা চলে যাওয়ার পর পুলিশ তার বাড়িতে এসে খোঁজখবর নেয়। তিনি বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে গুলিবর্ষণ করায় এ ঘটনায় রোববার কোতয়ালি থানায় একটি জিডি করেছেন। বিএনপি নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেন, একই রাতে সন্ত্রাসীরা লাল দিঘিরপাড়ে জেলা বিএনপি’র কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ব্যাপক তছনছ, নির্বাচনী যাবতীয় সরঞ্জাম লুট করে নিয়ে যায়। এমনকী সন্ত্রাসীরা কার্যালয়ের বাইরের একটি দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে যায়। বিএনপি কার্যালয়ে নির্বাচনী সংক্রান্ত কাজে অবস্থান করা জেলা যুবদলের প্রচার সম্পাদক এস্কেন্দার আলী জনি জানান, রাত ২টা ২৫ মিনিটের দিকে দুটি প্রাইভেটকার, একটি অ্যাম্বুলেন্স এবং বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেলে করে সন্ত্রাসীরা এসে আক্রমণ করে। এ সময় তিনি ৪ জন লেবারকে নিয়ে বিএনপি’র প্রার্থীর নির্বাচনী সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সন্ত্রাসীরা দুটি দরজার একটি ভেঙে ভেতরে ঢোকে। সন্ত্রাসীদের একজন তার বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে তার কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন সেট ও নগদ ৭ হাজার ৯শ’ টাকা কেড়ে নেয়। সেই সাথে লেবারদের কাছ থেকে তারা কয়েক হাজার টাকা ছিনিয়ে নেন। ওই সন্ত্রাসীরা বিএনপি কার্যালয়েও ব্যাপক তান্ডব চালায় এবং বিএনপি প্রার্থীর নির্বাচনী যাবতীয় কাগজপত্র লুট করে নিয়ে যায়। সন্ত্রাসীরা যে দুটি প্রাইভেটকারে এসেছিলো তার একটির (গাড়ো সবুজ রঙের গাড়ি) মধ্যে নৌকার প্রার্থীর পোস্টার ছিলো। তিনি বলেন, সন্ত্রাসীরা কার্যালয়ের একটি দরজায় তালা লাগিয়ে গেছে। জেলা বিএনপি’র আহবায়ক কমিটির সদস্য অ্যাড. হাজি আনিছুর রহমান মুকুল জানান, রাত ১২ টা ২৬ মিনিটের দিকে সন্ত্রাসীরা তার চাঁচড়া ডালমিলের বাড়িতে আক্রমণ করে। তারা এ সময় গেট ধাক্কাধাক্কি ও গালিগালাজ করে। বাড়ির কলিং বেল অন্তত ১৫ মিনিট চেপে ধরে আতঙ্কময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। একই রাতে জেলা বিএনপি’র আহবায়ক কমিটির সদস্য আব্দুস সালাম আজাদের বাড়িতেও গিয়ে সন্ত্রাসীরা গালিগালাজ করে বলে অভিযোগ করেন বিএনপি নেতা দেলোয়ার হোসেন খোকন। বিএনপি নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীরা রাতভর এই তান্ডব চালিয়েছে। অথচ পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক। তারা ওসির কাছে বারবার অভিযোগ করেছেন। কিন্তু পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং পুলিশ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বলে তারা মনে করছেন।
কোতয়ালি থানা পুলিশের ওসি মো. মনিরুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, নেতাদের অভিযোগ সঠিক নয়। তিনি অভিযোগ পাওয়া মাত্রই সেখানে পুলিশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। যারা এ ঘটনার সাথে জড়িত তাদের শনাক্তের কাজ চলছে। অপরদিকে নির্বাচনের প্রাক্কলে শীর্ষ নেতাদের বাড়ি ও দলীয় কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় উদ্বিগ্ন নেতৃবৃন্দ রোববার দুপুরে পুলিশ সুপার ও নির্বাচন কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। বিএনপি নেতা দেলোয়ার হোসেন খোকন জানান, পুলিশ সুপারকে না পেয়ে তারা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সালাউদ্দিন শিকদারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। এ সময় তারা ওই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে তাদের নিরাপত্তা বিধান এবং নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির দাবি জানান। এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপি’র আহবায়ক কমিটির সদস্য গোলাম রেজা দুলু, আব্দুস সালাম আজাদ, ধানের শীষের প্রার্থী নুর উন নবী, নগর বিএনপি’র সভাপতি সাবেক পৌর মেয়র মারুফুল ইসলাম প্রমুখ।