কঠোর আইনের পাশাপাশি বিচার প্রক্রিয়ার জটিলতা দূর করতে হবে : বিশেষজ্ঞদের মত

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥বেগমগঞ্জে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের পর ছাত্র সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠনের দাবির মুখে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এর আগে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন ছিল। আইন সংশোধনের এই উদ্যোগের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কঠোর আইনের পাশাপাশি বিচার প্রক্রিয়ার জটিলতা দূর না করলে এর কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না। যতো কঠোর আইনই করা হোক না কেন আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হলে কিছুতেই অপরাধ থামানো যাবে না। আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, পৃথিবীর শতকরা তিন চতুর্থাংশ দেশে মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে না। আর এক চতুর্থাংশ দেশে হচ্ছে। আমরা এক চতুর্থাংশের কাতারে।
এখন বাংলাদেশের জেলখানাগুলোতে প্রায় দুই হাজার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আছে। যাদের ইতিমধ্যে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে। ১৫ বছর আগেও এই সংখ্যা ২শ’র বেশি কখনো ছিল না। পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ দেশ বুঝে ফেলেছে যে, মৃত্যুদণ্ড দিলে একটি দেশ আরো বেশি নৃশংস ও বর্বর হয়। তখন সহিংস অপরাধ আরো বাড়ে। এটা আমাদের বুঝতে আরো ৫০ বছর লাগবে। এখানে মৃত্যুদণ্ডের আইন বলে কিছু নেই। এটা হবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধনী। যেখানে অপরাধীর জন্য মৃত্যুদণ্ড বলা আছে। এখানে অন্যান্য ধারার সঙ্গে একটি ধারায় মৃত্যুদণ্ড আরো যোগ করা হবে।
যেখানে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদণ্ড লিখবে। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ড আছে। এটা কি কমেছে? সারা পৃথিবীতে গত ১শ’ বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো শাস্তি যত বেশি হয়, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার তত কমে যায়। এখন আমাদের ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার শতকরা দুই থেকে তিন ভাগ। এর শাস্তি যদি মৃত্যুদণ্ড হয় তাহলে সাজা পাওয়ার হার শতকরা এক ভাগের নিচে নেমে আসবে। পক্ষান্তরে যদি সর্বোচ্চ সাজা ১০ বছর কারাদণ্ড হয় তাহলে আমার ধারণা শাস্তির হার অর্থাৎ শতকরা ৫০ জন ধর্ষকের শাস্তি হবে। অতএব আমি মনে করি শতকরা একজনের চরম শাস্তি এবং ৯৯ জন খালাস পাওয়া থেকে ৫০ জনের ১০ বছরের সাজা হওয়াটা ধর্ষণ হ্রাসের পক্ষে বড় পদক্ষেপ হবে। এবং অল্প কয়েকটি দেশে যেখানে ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ড আছে। সেখানে ধর্ষণ কমেছে বলে জানা যায়নি।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, মৃত্যুদণ্ড নয়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তির বিধান রাখা প্রয়োজন। এতে করে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটানো যাবে। তার মানে বিচার হবে। যারাই অন্যায় করে তারা যে দলের বা মতের হোক তাদের বিচার হবে এটা নিশ্চিত করলে। এবং সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান ও বিচারটিকে কার্যকর করা হবে- এটা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অর্থাৎ বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান। আরেকটি বিষয় হলো, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং বিচারহীনতা এই দু’টোই সবচেয়ে বড় সমস্যা। বিচার কার্যকর করতে হবে একইসঙ্গে কোনোরকম রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, এটা অপরাধ কমাবে কি-না জানি না। শাস্তি কতটুকু কম বা বেশি আছে এটা চিন্তা করে মানুষ অপরাধ করে না। অপরাধ করে কারণ দেশে অপরাধ করলে তার কোনো বিচার হয় না। এবং সে যদি ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকে তাহলে তার কোনো বিচার হয় না। তিনি বলেন, সরকার বিচার করে না। এখন শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেই কি! আর দুই বছর হলেই কি! আন্দোলনকারীদেরকে ঘরে ফিরিয়ে নিতে এটা করেছে। পৃথিবীর উন্নত দেশে মৃত্যুদণ্ডের আইন পাশের আগে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিষদ আলোচনা হয়। সংসদে আলোচনা হয়। এটা শুধুমাত্র আন্দোলনের পথ প্রশমিত করতে করেছে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে এটার রাজনৈতিক অপব্যবহার আরো বেশি হবে আগের চেয়ে।
আইনজীবী নাহিদ সুলতানা যুঁথি বলেন, সারা পৃথিবীতে বলতে গেলে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি উঠে গেছে। মৃত্যুদণ্ড কোথাও স্বীকৃত না। নতুন করে সমাজে মৃত্যুদণ্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়া ব্যক্তিগতভাবে আমি এর পক্ষে না। কিন্তু যেহেতু মৃত্যুদণ্ড দিতে চাওয়া হচ্ছে কারণ এটা একটি আইওয়াশ। যদি প্রশ্ন করা হয় মৃত্যুদণ্ডের জন্য ধর্ষণ কমে যাবে কি-না? উত্তরে বলবো, না! মৃত্যুদণ্ডের জন্য কখনোই ধর্ষণের ঘটনা কমবে না। ধর্ষণ তখনই কমবে যখন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিটা কার্যকর হবে। এক্ষেত্রে অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ক্ষেত্রে যদি ট্রাইব্যুনালের নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া এবং ওই সময়ের মধ্যে বিচার নিশ্চিত করা গেলে এটা হবে দৃষ্টান্তমূলক একটি শাস্তি। তখন অপরাধী অপরাধ করার আগে চিন্তা করবে, না! তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রেই আমি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে না। এবং সমর্থন করি না।