সংক্রামক মিথ্যা: ট্রাম্পের রোগ নিয়ে লুকোচাপা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ে যেই গোপনীয়তা, অর্থাৎ ১ লা অক্টোবর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ না করা থেকে শুরু করে তার সুস্থ হওয়ার খবর নিয়ে সাংঘর্ষিক তথ্য—এসব মার্কিন ইতিহাসে নজিরবিহীন নয়।
১৯১৯ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উডরো উইলসনের স্ট্রোক হয়েছিল। তার এই অসুস্থতা সংশ্লিষ্ট বিস্তারিত তথ্য কয়েক মাস যাবত গণমাধ্যমের কাছ থেকে মোটামোটি লুকিয়েই রাখা হয়েছিল। এসময় কার্যত দেশ পরিচালনা করেন তার স্ত্রী এডিথ বলিং উইলসন।
১৯৩২ সালে ফ্র্যাংকলিন ডি রুজভেল্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি পোলিও আক্রান্ত ছিলেন ও সেসময় চলাফেরা করতেন হুইলচেয়ারে করে। তার পরিবার এ তথ্য গোপন রাখতে চেয়েছিল। অবশ্য গণমাধ্যমও তখন হুইলচেয়ারে বসা অবস্থায় রুজভেল্টের ছবি না তুলতে সম্মত হয়েছিল। সেই হিসেবে তার বিষয়টি হয়তো অতটা গোপন ছিল না।
‘৫০ এর দশকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডুয়াইট আইজেনহাওয়ারের হার্ট অ্যাটাকের খবর ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন চিকিৎসকরা।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট তাদের থামিয়ে দিয়ে নিজের প্রেস সেক্রেটারিকে ‘সব বলে দিতে’ নির্দেশ দেন। ’৬০-এর দশকে জন এফ. কেনেডির পিঠে ব্যথা ও অন্যান্য সমস্যার কথা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।
কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করলে বলা চলে, ট্রাম্পের ক্ষেত্রে গোপন রাখার প্রথা ভেঙ্গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাব্য উল্লেখযোগ্য দিকটি হচ্ছে, কোভিড-১৯ একটি সংক্রামক রোগ।
উইলসনের ক্ষেত্রে, একজন ফার্স্ট লেডি কার্যকরভাবে দেশ পরিচালনা করা অত্যন্ত আপত্তিকর বিষয় হতে পারে, কিন্তু তাতে আমেরিকানদের স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি ছিল না। কারণ, তারা কেউই উইলসনের স্ট্রোক হওয়ার বিষয়টি জানতো না। কিন্তু, ট্রাম্প প্রশাসন গত বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্টের সহযোগী হোপ হিকসের করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর দ্রুত প্রকাশ না করে অনেককে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্টের সংস্পর্শে এসে ঠিক কতজন মানুষ অসুস্থ হয়েছেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। এখন পর্যন্ত আমরা জানি যে, ২৬শে সেপ্টেম্বর এমি কোনি ব্যারেটকে সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি হিসেবে মনোনীত করার ঘোষণা দেয়ার জন্য হোয়াইট হাউজে যেই অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়, সেখানে যোগদানকারী অন্তত সাত জন করোনা ভাইরাসের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ট্রাম্প একজন। ধারণা করা যায় যে, এই আক্রান্তদের প্রত্যেকেই অনুষ্ঠানের পরবর্তী দিনগুলোতে অন্যান্যদের সঙ্গে দেখা করেছেন। এ অনুষ্ঠানের পরে রিপাবলিকান সিনেটররা তাদের সহকর্মীদের সঙ্গে খাবার খেয়েছেন।
ওই অনুষ্ঠানের পর ২৯শে সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবার প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে হাজির হন। তারা এতটাই দেরি করে এসেছিলেন যে, ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকে তাদের পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। নিয়ম ভেঙে অনুষ্ঠানে যোগ দেন তারা।
হোপ হিকস করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর হোয়াইট হাউজ কর্মকর্তারা বৃহস্পতিবার সকালেই জানতে পেরেছিলেন বলে জানা গেছে। তা সত্ত্বেও, ব্লুমবার্গ নিউজ ঘটনাটি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের আগ পর্যন্ত প্রশাসন এ খবর প্রকাশ করেনি। সেদিন, ট্রাম্প নিউ জার্সিতে একটি ইনডোর প্রচারণা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যান ট্রাম্প। এরপর দাতাদের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন ও তার শিবিরের কর্মীরা ট্রাম্প ও হিকসের সঙ্গে একই কক্ষ ও মঞ্চে অবস্থান করেছিলেন বিতর্কের সময়। তা সত্ত্বেও ট্রাম্প শিবির বাইডেন শিবিরকে করোনা সংক্রমণের খবর জানায়নি। বাইডেন ও তার টিম হিকসের আক্রান্ত হওয়ার খবর জানতে পারেন গণমাধ্যম থেকে।
সবকিছু বিবেচনায়, এটা খুবই সম্ভব যে, হিকসের করোনা সংক্রমণের খবর প্রকাশে ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতা অন্যান্য মানুষজনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। এমনকি প্রেসিডেন্টের করোনা সংক্রমণ নিয়ে তথ্য প্রকাশ না করে এখনো সেই ঝুঁকি ছড়ানো হচ্ছে। গত রোববার সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট একটি গাড়িতে করে হাসপাতালের আশপাশে থাকা সমর্থকদের প্রতি হাত নাড়তে নাড়তে চলে যান। গাড়িটিতে ট্রাম্পের সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মীরাও ছিল। প্রেসিডেন্টের জন্য তারা গুলিবিদ্ধ হতেও প্রস্তুত। কিন্তু, এ ঘটনা এটাও প্রমাণ করে যে, প্রেসিডেন্টকে তার নিজের কাছ থেকে রক্ষা করা বা প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে অন্যদের রক্ষা করা, কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
প্রায় সব প্রেসিডেন্টই বাস্তব চিত্র যথাযথভাবে প্রকাশ করে না, বা কিছু গোপনীয়তা রাখে। কিন্তু এই প্রেসিডেন্ট ও তার সহযোগীরা এত বেশি মিথ্যা বলে ও এত খোলামেলাভাবে বলে যে, প্রেসিডেন্ট তার করোনা সংক্রমণ নিয়ে যে টুইট দিয়েছিলেন, সেটি নিয়েও অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন। অনেকে এমনও প্রশ্ন করেছেন যে, আসলেই তার করোনা সংক্রমণ হয়েছে, নাকি এটি তার করের নথিপত্র প্রকাশ ও বিতর্ক অনুষ্ঠানে বাজে পারফরমেন্স থেকে দৃষ্টি সরানোর কোনো কৌশল?
ট্রাম্পের করোনা সংক্রমণ নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা এমন সময়ে এসেছে যখন ডাকযোগে ভোট পাঠানো, আসন্ন নির্বাচনের নিরাপত্তা ও মহামারি সামাল দেওয়ায় ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও বিভ্রান্তি চলছে জনমনে।
ভাইরাসের মতো মিথ্যাও সংক্রামক হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। ট্রাম্পের শারীরিক অবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমকে দেওয়া বক্তব্যে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক শন কনলি শনিবার ও রোববার সাংঘর্ষিক তথ্য দেন। তিনি জানান, প্রেসিডেন্টের অক্সিজেন লেভেল কম ছিল, কিন্তু পরিস্থিতি প্রফুল্ল রাখতে এ তথ্য প্রকাশ করেননি তিনি।
এই নিবন্ধ লেখার সময়, সরকারি ভাষ্যমতে, প্রেসিডেন্টকে স্থানীয় সময় সোমবার হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। তবে আদৌ সত্য কিনা, তা কেউ জানে না। যেমন কেউ এটাও জানে না, আদতে প্রেসিডেন্টের ফুসফুসে কী হচ্ছে বা তাকে ডেক্সমেথাসোন দেওয়া হচ্ছে কিনা। উল্লেখ্য, সাধারণত গুরুতর করোনা আক্রান্তদের ডেক্সমেথাসন নামের স্টেরয়েড দেওয়া হয়ে থাকে।
এদিকে, রোববার যেদিন কনলির মুখে হাসি জড়িয়ে ছিল ও প্রেসিডেন্ট তার ভক্তদের দিকে হাত নেড়েছিলেন, সেদিন যুক্তরাষ্ট্র গত দুই মাসের মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ দেখেছে।
(লেখক নিউ স্টেসম্যানের মার্কিন সম্পাদক। তার এ লেখাটি নিউ স্টেটসম্যান অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে)