ডলারে এলসি করে মিলেছে পচা পেঁয়াজ!

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ভারত থেকে সর্বশেষ আসা পেঁয়াজের চেহারা দেখে ফিট লাগার অবস্থা আমদানিকারকদের। পেঁয়াজের ঝাঁজে চোখে জ্বালা ধরার বদলে এবার পেঁয়াজের বস্তার ওই চেহারা দেখেই আমদানিকারকদের চোখ দিয়ে ঝরছে কান্না। তাদের অভিযোগ, ডলার দিয়ে করা এলসির বিনিময়ে তাদের পেঁয়াজের বদলে পাঠানো হয়েছে পচা পেঁয়াজের জুস। তারা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সরকারের প্রতারণার শিকার। এরইমধ্যে অর্ধকোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বলে দাবি হিলির আমদানিকারকদের। কিছু আমদানিকারক পেঁয়াজের করুণ অবস্থা দেখে ক্ষতি পোষাতে, ওপারেই তার মাল খালাস করে বিক্রি করে যা পাওয়া যায় সেটুকুই বাঁচাতে রফতানিকারকদের অনুরোধ করছেন।
সর্বশেষ গত শনিবার হিলি সীমান্ত দিয়ে ১১ ট্রাক ভারতীয় পেঁয়াজ এসেছে। তবে এসব ট্রাক বাংলাদেশ স্থলসীমান্ত দিয়ে ঢোকার সময়েই দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। এগুলো গুদামে তুলতে গিয়ে আমদানিকারকদের এখন কপাল চাপড়ানোর দশা। লাভের চেয়ে ক্ষতি বেড়ে যাওয়াতে চোখে অন্ধকার দেখছেন তারা। আমদানিকারকরা বলছেন, কাঁচামাল, তাই আমদানির সময় বস্তায় সামান্য কিছু পেঁয়াজ নষ্ট থাকতে পারে এটা ধরেই নিয়েছিলেন তারা। কিন্তু, ভারত সরকারের হুট করে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার হঠকারী সিদ্ধান্তে টানা ১০ থেকে ১২দিন ত্রিপল ঢাকা ট্রাকে বস্তাবন্দি থাকাবস্থায় অর্ধেকের বেশি পেঁয়াজ সিদ্ধ হয়ে বিক্রির অনুপযুক্ত হয়ে গেছে। এ অবস্থায় পরে যে এলসি তারা করেছেন সেগুলো না পেলে এই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সহজ হবে না। এদিকে রবিবার ও সোমবার দুপুর পর্যন্ত কোনও পেঁয়াজ রফতানি করেনি ভারত।
হিলি স্থলবন্দরে গিয়ে দেখা গেছে, আমদানিকারকদের গুদামে ভারত থেকে আনা পেঁয়াজগুলো বাছাই করছে বেশ কয়েকজন শ্রমিক। প্রতিটি বস্তা থেকে প্রচুর পরিমাণ নষ্ট পেঁয়াজ বের হচ্ছে। ভালো পেঁয়াজগুলো বাছাই করে এক পাশে রাখলেও নষ্ট পেঁয়াজের পুঞ্জীভূত পরিমাণ ভালোর প্রায় সমান। যেগুলো কোনোমতে চলতে পারে সেগুলো ১শ’ থেকে ২শ’ টাকা বস্তা দরে বিক্রির জন্য হাঁকডাক চলছে, কিন্তু এর ক্রেতা নেই। হিলি স্থলবন্দরের আড়তগুলোতে পেঁয়াজ কিনতে আসা আব্দুল খালেক ও সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমদানি হওয়া বেশিরভাগ পেঁয়াজই পচা ও নষ্ট। আড়তগুলোতে যেসব পেঁয়াজ ঢেলে রেখেছে সেখানে তেমন ভালো পেঁয়াজ নেই বললেই চলে। আমরা এসব পেঁয়াজ কেনা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গিয়েছি। কী দামে কিনবো আর কী দামে বেচবো! এক বস্তার ভেতর অর্ধেকের বেশি পেঁয়াজ পচা বের হচ্ছে, কম দামে কিনলেও পুঁজিই হারানোর সম্ভাবনা আছে, পেঁয়াজের অবস্থা খুবই খারাপ। সিদ্দিক হোসেন নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, এক বস্তা পেঁয়াজ আড়াইশ’ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি। দেখি বাড়িতে গিয়ে এসব পেঁয়াজ বাছাই করে কতদূর ভালো বের হয়! গরিব মানুষ, তাই কিনলাম যদি বাজারের ৫ কেজির চেয়ে কিছু বেশি বের হয় এক বস্তা থেকে এই আশায়। তবে ৫০ কেজির বস্তা থেকে ৫/৭ কেজি ভালো পেঁয়াজ বের হবে কিনা তাতেই সন্দেহ হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে, ঠকলাম না তো আবার!
পেঁয়াজ কিনতে আসা শরিফুল ইসলাম নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, গতকালকে ভালো মানের কিছু পেঁয়াজ বেচাকেনা হয়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। কিন্তু পেঁয়াজ আর না ঢোকার কারণে সেই পেঁয়াজেরও দাম বেড়ে গেছে। প্রতি কেজি বর্তমানে ৬০ টাকা থেকে শুরু করে ৭০/৮০ টাকা দরেও বিক্রি হচ্ছে। অনেকের গুদামেই ভালো পেঁয়াজ রয়েছে, তারা স্টক করে রেখেছেন। ব্যবসায়ীরা দাম কমিয়ে বিক্রি করছেন না। হিলি স্থলবন্দরের পেঁয়াজ আমদানিকারক বাবলুর রহমান বলেন, গত বছরও একই সময়ে একই অবস্থা করেছিল ভারত। তার ঘা ব্যবসায়ীদের এখনও শুকায়নি, এর ওপর এ বছরও একই ধরনের কার্যক্রম চালিয়েছে তারা। আমরা বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানির জন্য এলসি খুলেছিলাম, অনেক পেঁয়াজও লোড হয়ে দেশে প্রবেশের অপেক্ষায় ছিল। তবে হঠাৎ করে ভারত সরকার গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়ে আবার ঝামেলায় ফেললো। তিনি বলেন, আমরা আশা ছিলাম শুক্রবারে নোটিফিকেশন জারি হবে। আটকে থাকা পেঁয়াজগুলো রফতানির অনুমতি দেবে। কিন্তু, তারা চালাকি করে মাত্র ১১ ট্রাক টেন্ডার করা পেঁয়াজ রফতানি করেছে। আমার নিজের ২৩ ট্রাক পেঁয়াজ ভারতের হিলি পার্কিংয়ে ছিল, যার অবস্থা এতই খারাপ হয়ে গেছে যে বলার ভাষাই আর নেই। পেঁয়াজের অবস্থা এমন হয়ে গেছে পেঁয়াজ দিয়ে পানি ঝরছে, পেঁয়াজের একেবারে জুস হয়ে গেছে। ১০/১২ দিন ধরে পেঁয়াজ ট্রাকে থাকলে সেই পেঁয়াজের আর কী থাকবে বলেন। কিন্তু যখন দেখলাম শুক্রবারেও অনুমতি দিলো না তখন আমাদের রফতানিকারকদের গুদামে সেসব পেঁয়াজ নামিয়ে রেখেছি। সেখানেই দেড়শ’ থেকে দুশ’ টাকা বস্তা দরে বিক্রি করছে। এখন এই এতদিন ধরে আটকে থাকা পেঁয়াজগুলো নিয়ে আমরা কী করবো? আমাদের তো বিল ছেড়ে দিতে হবে, এতে করে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো।
এই আমদানিকারক বলেন, আমাদের যেসব এলসি আগেই দেওয়া রয়েছে, ভারত সরকার যদি সেগুলো দেয় আর এর জন্য বাংলাদেশ সরকার ববস্থা নেয়, তাহলেই কেবল এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এক পাইকারি ক্রেতা পেঁয়াজ দেখে হতাশ। কী করে এমন পেঁয়াজ কিনবেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না তিনি। হিলি স্থলবন্দর আমদানি রফতানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন উর রশীদ বলেন, গত শনিবার আসা ১১ ট্রাক পেঁয়াজের অবস্থা অত্যন্ত করুণ ছিল। অধিকাংশ পেঁয়াজই বেশ কয়েকদিন আটকে থাকার কারণে পচে নষ্ট হয়ে গেছে, পেঁয়াজ দিয়ে পানি ঝরছিল। যার কারণে আমাদের অনেক পেঁয়াজ ফেলে দিতে হয়েছে। অধিকাংশ পেঁয়াজ কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে, কিছু কিছু পেঁয়াজ প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ১শ’ থেকে ২শ’ টাকা দরে বিক্রি করতে হয়েছে। আর বাছাই করা কিছু পেঁয়াজ একটু বেশি দামে বিক্রি করা গেছে। তবে ভারতের এমন আচরণে এই ১১ ট্রাক পেঁয়াজে আমাদের অর্ধকোটি টাকার ওপরে লোকসান গুনতে হয়েছে। বাকি পেঁয়াজ তারা এখনও পাঠায়নি। যদি আরও পরে সেগুলো পাঠায় তাহলে হয়তো ৭৫ ভাগের বেশি নষ্ট পাবো! এমন ক্ষতি মেনে নেওয়া সম্ভব হবে না। আমরা ভারতীয় রফতানিকারকদের চাপ সৃষ্টি করছি, যেহেতু আমরা ১০ হাজার টনের এলসি দিয়েছি, আপনারা এসব পেঁয়াজ রফতানি করেন। পয়সায় কেনা পেঁয়াজে ভারত সরকারের প্রতারণায় হতবিহ্বল আমদানিকারকরা।
উল্লেখ্য, কোনও নোটিশ না দিয়ে গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে ভারত সরকার। টানা ৫ দিন বন্ধ থাকার পর গত শনিবার হিলি, সোনামসজিদ ও ভোমরা বন্দর দিয়ে অল্প কিছু ট্রাক প্রবেশ করলেও লোড থেকে আনলোড পর্যন্ত ১০ থেকে ১২ দিন এসব পেয়াজ ত্রিপল ঢাকা ট্রাকে বস্তাবন্দি অবস্থায় আটকে থাকায় নষ্ট হয়ে গেছে। আমদানিকারকদের দাবি, ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পেঁয়াজই নষ্ট অবস্থায় পেয়েছেন তারা। এরপরও ক্ষতি পোষাতে সীমান্তের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা পেঁয়াজবাহী সব ট্রাকসহ এই বন্দর দিয়ে এলসি করা বাকি ১০ হাজার টন পেঁয়াজ রফতানির অনুরোধ জানিয়ে যাচ্ছেন তারা।