করোনায় ব্যবসা বন্ধ ২৪% অনলাইন নারী উদ্যোক্তার

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥দেশে গত কয়েক বছরে অনলাইনভিত্তিক বিপুলসংখ্যক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এসব উদ্যোক্তারা পণ্য ও সেবা বিপণন করতেন। কভিড-১৯-এর প্রভাবে গত ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অব্যাহতভাবে করোনার প্রতিঘাত চলতে থাকায় মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে যেসব নারী উদ্যোক্তা ঘরে বসে ব্যবসায় উদ্যোগ চালু করেছিলেন তাদের অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করেছেন।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত এপ্রিল থেকে মহামারীর প্রতিঘাত শুরু হলে জুন পর্যন্ত অনলাইন নারী উদ্যোক্তাদের ২৪ শতাংশ ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে একটি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে যেসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যবসা করতেন তারা এখন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্যপণ্য ও নিত্যপণ্য বিক্রি করত এমন অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলোয় করোনা মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। মহামারীর কারণে অনলাইন খুচরা বাজারে ফ্যাশন, কসমেটিকসসহ যেসব পণ্য বিক্রয় হতো সেগুলোর বিক্রি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুঁজি বাঁচাতে ক্রেতাদের অর্ডার বাতিল এবং পণ্য বিক্রি বন্ধ রেখেছেন।
বিশেষত অনলাইন পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রি বিশেষ দিবস কিংবা উৎসব কেন্দ্র করে। যেমন ঈদ, পহেলা বৈশাখ। কিন্তু এবারের ঈদ ও পহেলা বৈশাখে করোনা মহামারী আঘাত হানায় বড় ধরনের ব্যবসা করতে পারেনি এসব অনলাইন প্রতিষ্ঠান। সারা দেশ লকডাউনে থাকায় অনলাইনে পণ্য বিক্রি করা এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ক্রেতা হারিয়েছেন মাসের পর মাস। ৭৯-৮৪ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, গত ঈদ ও পহেলা বৈশাখে যৎসামান্য আয় করতে পেরেছেন তারা। তবে এর প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি পড়েছে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের ওপর, যারা অনলাইনে উপার্জনটাকে নিজেদের একমাত্র আয়ের উৎস হিসেবে ধরে নিয়ে কাজ করতেন। একই সঙ্গে অনলাইন এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত কর্মচারীদের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত এক মাসে ক্ষুদ্র এসব ব্যবসায় উন্নতি না হওয়ায় ১২১ জন কর্মী কাজ হারিয়েছেন। কভিড মহামারী এভাবে চলতে থাকলে আগামী সাত মাসে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি চালু হতে না পারলে ৫৫০ জনেরও অধিক কর্মী এ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে চাকরি হারাতে পারেন বলে গবেষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
তবে এসব উদ্যোক্তার অনেকেই মনে করেন, পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হলে ব্যবসায়ে সুদিন ফিরবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বড় একটি অংশ এখনো নিজেদের ব্যবসার প্রতি আত্মবিশ্বাসী। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আত্মবিশ্বাস, এপ্রিলে ১৫ শতাংশ থাকলেও ২১ শতাংশ বেড়েছে জুনে। ব্যবসায়িক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা-আত্মবিশ্বাসের জায়গা ৩০ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশে নেমে এসেছে। জরিপে অংশ নেয়া অর্ধেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বিশ্বাস করেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে ব্যবসায়িক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন তারা।
একই সঙ্গে নারী উদ্যোক্তারা এখনো এপ্রিল থেকে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। যেমন অর্ডার বাতিল, ডিসকাউন্ট, কর্মচারীদের বেতনেও কাটছাঁট করে চলেছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, এপ্রিলের তুলনায় জুনে পণ্যের অর্ডার বাতিল কম করা হলেও পণ্যে ছাড়ের সুযোগটি আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এপ্রিলে যেটি ১৩ শতাংশ ছিল, জুনে তা ৩৩ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এপ্রিলে কর্মী ছাঁটাইয়ের বিষয়টি যেখানে ৪ শতাংশ ছিল, সেখানে ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মহামারী মোকাবেলায় ক্ষুদ্র এ উদ্যোক্তাদের টিকিয়ে রাখতে হলে যথাযথ পদক্ষেপ, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে হবে। তবে হতাশার বিষয় হলো, ৬৫ শতাংশ এসব ব্যবসায়ীর ট্রেড লাইসেন্স কিংবা সরকারি কোনো নিবন্ধন নেই। তারা সরকারের দেয়া প্রণোদনা প্যাকেজের আওতাভুক্ত হতে পারছেন না। তাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায়। ৬৮ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাদের ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে এসব ব্যবসা করছেন, বাকি ২০ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধার নিয়ে এ পথে নেমেছেন। ৬৩ শতাংশ উদ্যোক্তা সরকারি এ সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে জানাশোনা না থাকায় তারা অন্য মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে মুনাফা খোঁজার চেষ্টা করেন। বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়লে ব্যবসা বাঁচাতে এসব উদ্যোক্তার বেশির ভাগ পারিবারিক সহায়তা, বন্ধুবান্ধবদের সহযোগিতাসহ নানা মাধ্যম খুঁজে বেড়ান।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে, এসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ কিংবা প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। ফলে বিরূপ পরিস্থিতিতে ব্যবসা না থাকায় বেশির ভাগ উদ্যোক্তা বাড়িতে বসে অলস সময় পার করেন। ফলে ব্যবসা বা অফিস সম্পর্কিত কাজে এসব উদ্যোক্তার সময়কে হ্রাস করে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিডব্লিউসিসিআই) সভাপতি ও সংসদ সদস্য সেলিমা আহ্মাদ বলেন, কভিড-১৯ প্যাকেজে ‘নারী উদ্যোক্তাদের’ জন্য আলাদা কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। যদিও এসব নারী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে ভূমিকা রেখে চলেছেন।
বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন বলেন, গবেষণাটি ‘অনুসন্ধানী’ মূলক। এটি বাংলাদেশে নতুন ও উদীয়মান একটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছে। আমরা বিশ্বাস করি, এ গবেষণা ডিজিটাল স্পেসে ব্যবসা করার জন্য ভবিষ্যতে এ ধরনের গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
বিআইজিডি সিনিয়র ফেলো মাহিন সুলতানা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ২ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ৫ শতাংশ প্রণোদনা কী ধরনের, সেটি ব্যাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে পরিষ্কার নয়।
বিআইজিডি গবেষণা প্রধান মেহনাজ রাব্বানী উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, উদ্যোক্তাদের চাহিদা ও প্রত্যাশা অনুযায়ী সহায়তা দেয়া না হলে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ছাঁটাইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ফলে বেকারত্বের সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে নারীর ক্ষমতায়নকে আরো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে