বিনিয়োগ-বাণিজ্য বৃদ্ধিতে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে এফটিএর তাগিদ

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ২০১৮ সালে বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩৭ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশের মোট বিদেশী বিনিয়োগের ১০ শতাংশ। যদিও ২০১৮ সালে এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোয় যুক্তরাজ্যের মোট বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ১৮ হাজার ৬০০ কোটি ব্রিটিশ পাউন্ড। কিন্তু বাংলাদেশ এসেছে মাত্র শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ। এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে কমে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যে ৩৪৫ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করে। এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) তাগিদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের ব্যক্তিখাতের প্রতিনিধি ও গবেষকরা। গতকাল এক ওয়েবিনারে এ তাগিদ দেন তারা।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) ‘যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্য এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা’ শীর্ষক ওয়েবিনারের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ওয়েবিনারে যুক্ত ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন এবং যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম।
স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বন্ধুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সম্পর্ক বিদ্যমান এবং বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগকারী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যের অবস্থান দ্বিতীয়, যেখানে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে ২ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং প্রায় ২০০টি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন মূল্যের পণ্য যুক্তরাজ্যে রফতানি করে। যেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ব্রিটিশ বিনিয়োগ আকর্ষণে তিনি নতুন পণ্যের উদ্ভাবন এবং পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর জোরারোপ করেন।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে বৃহৎ প্রকল্পগুলোয় যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ আকর্ষণে ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার বন্ড’ চালুর প্রস্তাব করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যকার বাণিজ্য সম্প্রসারণে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্থাপনের জন্য দুই দেশের সরকারের উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।
আয়োজিত ওয়েবিনার ডায়ালগে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ আরো বৃদ্ধিতে বাংলাদেশী রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ, যথাযথ নীতিমালা ও কৌশল প্রণয়ন, ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় হ্রাস, দ্রুততম সময়ে অবকাঠামো এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর (এসইজেড) কার্যক্রম বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ২০২৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা নিয়ে পণ্য রফতানি করতে পারবে, যা আমাদের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক একটি বিষয়। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক ডায়ালগ আয়োজন, দুই দেশের বাণিজ্য সংগঠনগুলোর মধ্যে যোগাযোগ আরো সুদৃঢ়করণ, কভিড-উত্তর বাণিজ্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় ‘মার্কেট স্ট্র্যাটেজি’ প্রণয়ন এবং ব্রিটিশ-বাংলাদেশীদের আরো বেশি হারে বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহী করার প্রস্তাব করেন।
যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম বলেন, ব্রিটিশ বাণিজ্য সংগঠনগুলো বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য খাত বিষয়ে খুব বেশি অবগত নয় এবং এ অবস্থা উত্তরণে বাংলাদেশের চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ই-কমার্স বাজার রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশী তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে। হাইকমিশনার বলেন, ব্রিটেনে হালাল পণ্য এবং লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে বিশাল বাজার রয়েছে এবং বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা সহজেই এ সুযোগ গ্রহণ করে আরো বেশি হারে পণ্য যুক্তরাজ্যে রফতানি করতে পারেন।
বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ একান্ত আবশ্যক উল্লেখ করে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন বলেন, বাংলাদেশের ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেবা এবং আর্থিক খাতগুলোয় ব্রিটিশ বিনিয়োগ আকর্ষণে যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এছাড়া তিনি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় হ্রাস, প্রয়োজনীয় নীতিমালার সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
নির্ধারিত আলোচনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) শরীফা খান, ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসেন খালেদ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম, বেসিসের সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মোক্তাদির, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সিইও আহসান খান চৌধুরী এবং রহিমআফরোজ স্টোরেজ পাওয়ার বিজনেসের নির্বাহী পরিচালক ফারাজ এ রহিম অংশগ্রহণ করেন। ওয়েবিনারে ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি এনকেএ মবিন ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সিইও আহসান খান চৌধুরী ব্রিটেনে বাংলাদেশী পণ্য ও সেবা রফতানি বাজার সম্প্রসারণে দুই দেশের মধ্যকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষর, রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং বাংলাদেশী করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো বেশি হারে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে প্রবর্তিত ‘বাংলা বন্ড’-এ বিনিয়োগের প্রস্তাব করেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) শরীফা খান জানান, ব্রিটিশ সরকার ২০২৭ পর্যন্ত বাংলাদেশী পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা প্রদান করছে এবং বাংলাদেশী পণ্য রফতানিতে বিদ্যমান শুল্ক কাঠামোর বিষয়টি আলোচনাধীন রয়েছে।
রহিমআফরোজ স্টোরেজ পাওয়ার বিজনেসের নির্বাহী পরিচালক ফারাজ এ রহিম ব্রিটেনে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের পণ্য রফতানির ওপর জোরারোপ করেন এবং বাংলাদেশে ব্রিটিশ বিনিয়োগ আকর্ষণে আমাদের স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের কোম্পানিগুলোকে যৌথ বিনিয়োগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মোক্তাদির ব্রিটেনে বাংলাদেশী ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের নিবন্ধন পেতে সে দেশের এমএইচআরএর সঙ্গে বাংলাদেশী ওষুধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার যোগাযোগ স্থাপনে বাংলাদেশস্থ ব্রিটেনের দূতাবাসকে সহযোগিতার আহ্বান জানান।
বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট তৈরিতে নিয়োজিত যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগের আহ্বান জানান।
ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি হোসেন খালেদ দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ সম্প্রসারণে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় হ্রাস এবং ভ্যালু চেইন স্থাপনের প্রস্তাব করেন।
আসিফ ইব্রাহীম জানান, শিগগিরই বাংলাদেশের দুটি পুঁজিবাজারই অটোমেশন কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা হবে এবং ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আহ্বান জানান।
মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিল্ডের চেয়ারম্যান আবুল কাসেম খান ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোকে আরো বেশি হারে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান। এছাড়া তিনি দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাত উন্নয়নে জিডিপির ৬ শতাংশ বিনিয়োগের প্রস্তাব করেন, যেটি বর্তমানে রয়েছে প্রায় ২ দশমিক ৩ শতাংশ।