অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম: পিছিয়ে পড়ছে সুযোগ বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা

0

শেখ আব্দুল্লাহ হুসাইন ॥ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রায় তিন মাস বন্ধ রয়েছে। এ সংকটকালে শিক্ষার্থীরা যেন পিছিয়ে না পড়ে সেজন্য অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে অনলাইন পাঠদান চালু করেছে। পাশাপাশি সংসদীয় টিভি চ্যানেলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কাস কার্যক্রম সম্প্রচার করা হচ্ছে। তবে আর্থিক কারণে অনলাইন ও টিভি সম্প্রচারে সব শিক্ষার্থীর দেখা ও শেখার সুযোগ না থাকায় তাদের বড় একটি অংশ শিক্ষা কার্যক্রম থেকে পিছিয়ে পড়ছে। যশোরে বেশ কিছু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের নিজ নিজ শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া কার্যক্রম অনলাইন কাসের মাধ্যমে চালু করেছে। ইতোমধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের অনলাইনে বিশেষ মূল্যায়ন পরীক্ষাও নেয়া শুরু হয়েছে। অভিভাবকদের স্মার্ট মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও কম্পিউটারে শিক্ষার্থীরা কাস করছে। মোবাইল ফোনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও অন্যান্য মাধ্যমে অনলাইন কাস নেয়া হচ্ছে। শিক্ষকরা অনলাইনে পাঠদান বুঝিয়ে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের। পরবর্তীতে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। ফেসবুকের কমেন্ট বক্সে শিক্ষার্থীরা উত্তরপত্র পোস্ট করছেন। উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে শিক্ষকরা নম্বর দিচ্ছেন। এসব কার্যক্রমে মোটামুটি শহরের শিক্ষার্থীরাই বেশি অনলাইন সুবিধা ভোগ করছে। তবে যেসব অভিভাবকের হাতে স্মার্টফোন নেই বা টেলিভিশন কেনার মত ক্ষমতা কিংবা তাতে স্যাটেলাইট কেবল সংযোগ করা নেই বা যাদের বিদ্যুৎ সংযোগ পর্যন্ত নেই তাদের সন্তানরা অনলাইন শিক্ষা থেকে সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে। আবার স্মার্টফোন থাকলেই হবে না, তাতে ইন্টারনেট সংযোগও থাকতে হবে, যা বাড়তি টাকা দিয়ে কিনতে হয়। সেসব ক্ষমতাও নেই অনেক অভিভাবকের। এ কারণে শিক্ষাবিদরাও বর্তমান অনলাইন পদ্ধতির শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি সফল না হওয়ার আশঙ্কা করছেন। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে গত ১৮ মার্চ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। এর প্রকোপ অব্যাহত থাকলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের কাস কার্যক্রম সংসদীয় টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার করা হচ্ছে।
যশোর সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার মো. আব্বাস উদ্দীন বলেন, ‘সব শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের হাতে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার নেই বা ঘরে টেলিভিশনও নেই। যে কারণে ওই শিক্ষার্থীরা সংসদীয় টিভি চ্যানেল বা মোবাইল ফোনে পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে আমরা সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষকদের মাধ্যমে ওইসব শিক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ করে টিভিতে প্রচারিত পাঠদান মোবাইল ফোনে ধারণ করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য বলেছি। আর শিক্ষকরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। তাছাড়া যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ, অনলাইন ও টিভি সুবিধা নেই সেগুলো তালিকা করে মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরে পাঠানো হচ্ছে। সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে সেভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যশোর জেলায় সরকারি-বেসরকারি, নি¤œ-মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে ৫২২টি, স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে ১৫টি, মাদ্রাসা ৩১০টি ও কলেজ রয়েছে ৮৯টি। মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৯৩৬টি। বর্ডার গার্ড পাবলিক স্কুল, যশোর এর অধ্যক্ষ মো. আবু দাউদ বলেন, করোনাভাইরাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বর্তমানে সংসদীয় টিভি চ্যানেলে পাঠদান কার্যক্রম চলছে। তাদের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ফোন করে সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন। তাছাড়া মে মাস থেকে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে অনলাইন কার্যক্রম চালু হয়েছে। পুলিশ লাইন মাধ্যমিক স্কুল, যশোর এর প্রধান শিক্ষক মনোতোষ কুমার নন্দী বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তারা এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে অনলাইন পাঠদান কার্যক্রম চালু করেছেন। সেক্ষেত্রে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গ্রুপ করে অভিভাবকদের আইডি দিয়ে জয়েন করে প্রোফাইল খুলে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম চালু করেছেন। দাউদ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, যশোর এর অধ্যক্ষ মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সরকার দেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গত ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করে। আমরা বিলম্ব না করে পরের সপ্তাহ থেকে অর্থাৎ গত ২৬ মার্চ থেকে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করে দিই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেজে কাস ওয়ান থেকে ইলেভেন পর্যন্ত পাঠদান অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে অনলাইনে বিশেষ মূল্যায়ন পরীক্ষাও নেয়া হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনলাইনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে প্রচুর উৎসাহ ও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।’
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ট্রেজারার ও যশোর শিক্ষা বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. আব্দুল মজিদ লোকসমাজকে বলেন, ‘মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের দেশে বর্তমান যে অবস্থা, তাতে সরাসরি পাঠদান প্রক্রিয়ার মধ্যে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে বিকল্প হিসেবে অনলাইন বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠদান কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই প্রক্রিয়া কেবলমাত্র শুরু হয়েছে বলা যায়। বিশ^বিদ্যালয়েও আমরা এই পদ্ধতিটা পুরোপুরি এখনও পর্যন্ত সফল করতে পারিনি। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি সব প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনতে। আমরা ধরে নিয়েছি যে সেপ্টেম্বরের আগে করোনামুক্ত হতে পারছি না। কিন্ত আমাদের তো শিক্ষাবর্ষ কমপ্লিট করতে হবে। ফলে অনলাইন পদ্ধতি পুরোপুরি সফল না হলেও এটা সরকারের একটি উদ্যোগ, এর বিকল্প কোনো উপায়ও নেই। তবে ভবিষ্যতে আমরা সবকিছু ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনার চেষ্ট করবো, পাশাপাশি অ্যানালগও থাকবে। আমরা এখন সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।’ বাংলাদেশে সব শিক্ষার্থী আর্থিক কারণে অনলাইন সুবিধা ও টেলিভিশনে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন না, এ বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রফেসর আব্দুল মজিদ বলেন, ‘শুধু নিচের কাসেই নয়, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যারা গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে গেছে তাদের অনেককেই এই অনলাইন পদ্ধতিতে আনা যায়নি।’