করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় আমরা কোথায় যাচ্ছি?

0
ড. বদিউল আলম মজুমদার
গত ১৬ই এপ্রিল সরকার সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮-এর ১১ (১) ধারার ক্ষমতাবলে সমগ্র বাংলাদেশকে করোনা ভাইরাসের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছে। সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছে: ‘বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস মহামারি আকারে বিস্তার লাভ করেছে। এ কারণে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে … বাংলাদেশেও বিভিন্ন জায়গায় এ রোগের সংক্রমণ ঘটেছে।’ এটি একটি অত্যন্ত তাৎপর্য ঘোষণা। এ ঘোষণার মাধ্যমে সরকার স্বীকার করে নিয়েছে যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ‘কমিউনিটি ট্রেন্সমিশনে’র স্তরে পৌঁছেছে এবং এটি গ্রামগঞ্জ, পাড়া-মহল্লা সব এলাকায়ই ছড়িয়ে পড়েছে, যদিও পর্যাপ্ত পরীক্ষার অভাবে তার ব্যাপকতা ধরা পড়ছে না। ফলে আমরা কেউই, যে যেখানেই থাকি না কেন, এর থেকে নিরাপদ নই। তাই কার্যকর ব্যবস্থার অভাবে ভবিষ্যতে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সংক্রমণ ও মৃত্যু অনিবার্য বলে অনেকের ধারণা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সংক্রমণের বিস্তার চারটি স্তরে হয়ে থাকে। প্রথমত, বিদেশি উৎস। এ স্তরে ভ্রমণের মাধ্যমে সংক্রমণ বিদেশ থেকে আসে এবং এর প্রকোপ একটি বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ঘটনা। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সংক্রমণ (Local transmission)। এ স্তরে সংক্রমণের উৎস জানা এবং তা চিহ্নিত করা সম্ভবÑ যেমন, পরিবার কিংবা কোনো সুনির্দিষ্ট সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শ। তৃতীয়ত, সামাজিক পর্যায়ে সংক্রমণ (Community transmission)। এ স্তরে সংক্রমণের উৎস অজানা এবং বহু জায়গায় সংক্রমণ দৃশ্যমান। এ ক্ষেত্রে পুরো সমাজে সংক্রমণের পরিমাণ এত ব্যাপক যে, কোনো জানা সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে না এসেও কিংবা সংক্রমণ ঘটেছে এমন কোনো দেশে না গিয়েও যে কোনো ব্যক্তির সংক্রমিত হওয়া সম্ভব। ফলে এ স্তরে দেশব্যাপী জ্যামিতিক হারে দাবানলের মতো সংক্রমণের বিস্তার ঘটে, যা ইতালি, স্পেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা লক্ষ্য করেছি। চতুর্থত, মহামারি। এ স্তরে সংক্রমণ মহামারির পর্যায়ে পৌঁছে এবং ব্যাপকহারে মৃত্যু ঘটায়। এটি সুস্পষ্ট যে, আমরা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ বা সীমিত করণ (Containment) করতে পারিনি, তাই আমাদেরকে এখন প্রশমনের (Mitigation) দিকে নজর দিতে হবে। গত কয়েক মাসে বিদেশ থেকে প্রায় সাত লাখ বাংলাদেশি দেশে ফিরে এসেছে, যা এখনও স্রোতের মত অব্যাহত রয়েছে। এরা অনেকে এসেছে করোনা ভাইরাসের ছোবলে জর্জরিত দেশ থেকে। এদেরকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে কোয়ারেনটিনে রাখা প্রয়োজন ছিল, যা আমরা করতে পারিনি। এ নিয়ন্ত্রণের অভাবে এদের মাধ্যমে সারা দেশে ভাইরাসটি সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ পায়। এরপর সরকার গত ২৬শে মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি এবং এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক লকডাউন ঘোষণা করে। এর ফলে এক কোটির বেশি শহরবাসী বিভিন্ন যানবাহনে গাদাগাদি করে, সামাজিক দূরত্ব না মেনে, গ্রামে ছুটে যায়। এর মাধ্যমে শহর থেকে গ্রামে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়।
সাধারণ ছুটি শেষে ৪ঠা এপ্রিল অনেকে, বিশেষত পোশাক শিল্পে কর্মরত বহু ব্যক্তি ছোট ছোট বাহনে, এমনকি হেঁটে কর্মস্থলে পৌঁছে জানতে পারে যে তাদের কারখানা খুলছে না। এদের মধ্যে অনেকে আবার ফিরে যায় গ্রামে। এভাবে যাওয়া আসার মাধ্যমেও করোনা ভাইরাস ছড়াতে থাকে সারা দেশে। অর্থাৎ সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কঠোরতার অভাব করোনা ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়।
করোনা ভাইরাস যে এরই মধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তার প্রতিফলন দেখা যায় সরকারের প্রকাশিত সংক্রমণের তথ্য থেকে। গত ৮ই মার্চ নমুনা পরীক্ষা শুরু হয় এবং প্রথমদিকে তা অত্যন্ত ধীর গতিতে চলতে থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় মাস থেকে নমুনা পরীক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমিত রোগী ও মৃতের সংখ্যাও বাড়তে থাকে দ্রুতগতিতে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরই প্রতিফলন আমরা দেখছি নমুনা পরীক্ষার দ্বিতীয় মাসে মোট আক্রান্তের ৯৮ শতাংশের শনাক্তের মধ্য দিয়ে। আর দেশে করোনা ভাইরাসের কারণে মৃতের সংখ্যা ১০০ পৌঁছেছে শনাক্ত শুরুর ৪৪ দিনে, যা ২০০ ছড়াতে সময় লেগেছে মাত্র ১৮ দিন। প্রসঙ্গত, প্রথমদিকে সংক্রমণ মূলত ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে সীমাবদ্ধ থাকলেও, বর্তমানে তা দেশের ৬৪ জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছে।
আমরা এখন নমুনা পরীক্ষার দশম সপ্তাহে- নবম সপ্তাহ শেষ হয়েছে ৯ই মে। সংযুক্ত গ্রাফ থেকে লক্ষ্য করছি যে চতুর্থ সপ্তাহ থেকে সংক্রমণের সংখ্যা ক্রমাগত ভাবে বাড়ছে এবং নবম সপ্তাহে সংক্রমণের সংখ্যা এসে দাঁড়িছে চার হাজার ৯৮০ জনে। আর দশম সপ্তাহের প্রথম দিনেই- ১০ মে- নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ৮৮৭ জনে। প্রথম আলো’তে (১১ মে ২০২০) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, লকডাউন চলাকালীন সময়ে ৮ জনের এক বিশেষজ্ঞ দল সরকারকে একটি পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে মে মাসের ১৬-১৮ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশে সংক্রমণ চূড়া বা পিকে পৌঁছতে পারে, যা বেশকিছু দিন অব্যাহত থাকবে এবং ঈদের পর তা কমতে থাকবে।
তবে সংক্রমণের ব্যাপ্তি ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়লেও এ তথ্যের নির্ভরতা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১ লাখ ২২ হাজার ৬৫৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে -প্রতি দশ লাখে ৭২১ জনের মত Ñযা বিশেষজ্ঞদের মতে অত্যন্ত অপ্রতুল এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়ও কম। তাই অপেক্ষাকৃত অল্প পরিমাণের করোনা ভাইরাসের রোগী ও মৃতের সংখ্যা ভাইরাসের বাংলাদেশে বিস্তারের ব্যাপকতার পরিপূর্ণ প্রতিফলন নয়। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে রোগী শনাক্তের হার অপেক্ষাকৃত বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে যেখানে সংক্রামণের হার ৩ দশমিক ৯১, সেখানে বাংলাদেশে তা ১১ দশমিক ৯৪।
করোনা ভাইরাসের রোগীর ও মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত ভাবে বাড়া সত্ত্বেও সরকার লকডাউন শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ২৬শে এপ্রিল থেকে পরিপূর্ণভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষার শর্ত সাপেক্ষে তৈরি পোশাক কারখানা খুলে দেয়। একই দিন থেকে ইফতারি বিক্রির জন্য দোকান খোলার অনুমতিও দেয়। এর পর ৮ই মে থেকে সরকার কিছু শর্ত সাপেক্ষে মসজিদে নামাজ পড়ার অনুমতি দেয় এবং ১০ই মে থেকে শপিং সেন্টার খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যদিও অনেক মালিক শপিং সেন্টারের বন্ধ রেখেছে। লকডাউন শিথিল করার সিদ্ধান্ত কারিগরি বিষয় হলেও, প্রথম আলো’র (১১ মে ২০২০) প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ ব্যাপারে সরকার গঠিত ১৭ সদস্যের কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির মতামত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষনেয়নি।
করোনা ভাইরাস বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য জীবনের ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। একইসঙ্গে এটি তাদের জীবিকার ওপর ভয়াবহ থাবা ফেলেছে। মানুষের জন্য জীবন ও জীবিকা উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। জীবিকা অর্জনের সুযোগ ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। আর জীবন না থাকলে জীবিকা অর্থহীন। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া বিষয়ে উভয় বিষয়ই বিবেচনায় নেয়া আবশ্যক। কিন্তু নমুনা পরীক্ষার অপ্রতুলতা সত্ত্বেও যেখানে রোগী ও মৃতের হার ক্রমাগতভাবে বাড়ছে, সেখানে লকডাউন শিথিল করার সিদ্ধান্ত- বিশেষত কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির মতামত না নিয়েই আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। ফলে আমরা কোনদিকে যাচ্ছি তা নিয়ে অনেকের মতো আমাদের মনেও প্রশ্ন জেগেছে। সরকার এ ব্যাপারে আলোকপাত করে নাগরিকদের আস্থায় নেবে বলে আশা করি, যা করোনা ভাইরাস সৃষ্ট এ ভয়াবহ দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়ক হবে।
লেখক: সম্পাদক, সুজনÑসুশাসনের জন্য নাগরিক