মুখোশে বিশ্ব

0
আলমগীর মহিউদ্দিন
মানুষ মুখোশ পরে আত্মগোপন করতে, পরিচয় লুকিয়ে রাখতে অথবা আত্মরক্ষা করতে। বিশ্বের মানুষের মুখে এখন মুখোশ। এ মুখোশ পরেছে তারা মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে। এই রোগের কারণে যে ভীতি-শঙ্কা-অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে, তা আগে কখনো কোনো কারণে সৃষ্টি হয়নি। বিশ্বব্যাপী কোনো রোগ এভাবে কখনো আত্মপ্রকাশ করেছে বলে জানা যায় না। এই একটিমাত্র রোগ যার কোনো প্রতিষেধক বিজ্ঞানীরা এখনো আবিষ্কার করতে পারেননি। আবার এই রোগ এমনিতেই সেরে যাচ্ছে। সেরে যাচ্ছে সাধারণ রোগের চিকিৎসায়। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন এই রোগ হচ্ছে এবং বাঁচার উপায় কী? এ প্রশ্নগুলোর নানা জবাব বিভিন্ন দিক থেকে আসছে। বিজ্ঞানীরা খুঁজছেন তাদের মতো করে এবং বলছেন, এটা প্রকৃতির দান। বিশ্বাসীরা বলছেন, এটা সৃষ্টিকর্তার সতর্কতা। নাস্তিকরা অবশ্য অনেক আলোচনা করলেও এর উৎস খুঁজে পাচ্ছেন না।
এই নানা আলোচনার মধ্য দিয়ে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে- অবশ্য সময় কারো জন্য বসে থাকে না। এখানে আধুনিক বিজ্ঞানীদের কথা ধরা যাক। তাদের একটি কৃতিত্ব হলো- তারা উৎস বের করতে পারলে অতি দ্রুত সমস্যার প্রতিষেধক তৈরি করতে পারেন। এবার তারা যেন পরাস্ত হয়েছেন। তারা করোনা নিয়ে গবেষণায় প্রথম প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন। কেমন করে করোনাভাইরাস দেহে আক্রমণ করে। তারা পেয়েছেন- এই ভাইরাস মানুষের দেহে বাতাসের মধ্য দিয়ে নিঃশ্বাসের সাথে নাক দিয়ে প্রবেশ করে জীবন্ত কোষগুলোর ওপর ভর করে নিজেকে বিভক্ত করে সংখ্যা বাড়াতে থাকে। আর প্রথমে আক্রমণ করে ফুসফুসকে। সেই সাথে দেহের অন্যান্য কোষকেও অসুস্থ বানাতে থাকে। সাধারণত দুই থেকে ১৪ দিনের মধ্যে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আয়ত্তে আনে। তার পর শুরু হয় তাদের তাণ্ডবলীলা।
করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি হাঁচি-কাশি দিলে ওই ভাইরাসগুলো বাতাসে ভেসে যায় অথবা থুথু ফেললে সেখানে অবস্থান করে। কোনো সুস্থ ব্যক্তি এর সংস্পর্শে এলে ওই ভাইরাসগুলো নাক দিয়ে ঢুকে প্রথমে গলায় অবস্থান নেয়। এ ছাড়া এরা চোখেও অবস্থান করতে পারে। পরে উপসর্গ হিসেবে উপস্থিত হয় জ্বর, কাশি, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট, দুর্বলতা, শরীরে ব্যথা, মাথা ধরা, খাবারে বিস্বাদ, গন্ধ ও ডায়রিয়া। এটি যেহেতু গলার কোষে (এসিই-২) ভর করে, তাই এরা দেহের গভীরে প্রবেশ করে সহজেই। এ দিকে সাধারণ সর্দি-কাশির চেয়ে এর আক্রমণের ব্যাপকতা বেশি। ফলে নিউমোনিয়াসহ নানা রোগ সহজেই দেহ দখল করে। পাঁচ থেকে আট দিনের মধ্যে উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। তার মধ্যে সবচেয়ে কষ্টকর ও ভয়ঙ্কর হলো- শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট। একে বলা হয় অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম (এআরডিএস)। যখন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তখন ভেন্টিলেটর মেশিন ব্যবহার করে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখার চেষ্টা করা হয়। কখনো কখনো এআরডিএসের কারণে ফুসফুসে, ফ্লুইড (তরল পদার্থ) জমা হতে থাকলে দেহে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হতে থাকে। ফলে কিডনিসহ নানা অঙ্গ অচল হতে থাকে।
ভাইরাসটি কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন বেঁচে থাকে পরিবেশ অনুসারে। যেমন- দরজার খিল, গয়না বা রুপার বাসনের ওপর পাঁচ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে। এ ছাড়া ফার্নিচার, ডেকের ওপর চার দিন; প্যাকেট; দুধের বাসনের ওপর দুই-তিন দিন; বাজারের ব্যাগের ওপর ২৪ ঘণ্টা; চায়ের কেটলি, রান্নার বাসনে দুই-চার ঘণ্টা; পানির গ্লাসে দুই থেকে আট ঘণ্টা; অ্যালুমিনিয়ামে প্রস্তুত আধারে-বোতল, থালা ইত্যাদিতে দুই থেকে আট ঘণ্টা; কাচের গ্লাস, জানালা ও মাপযন্ত্রে পাঁচ দিন পর্যন্ত বাঁচে। সাধারণত কাগজের ওপর করোনাভাইরাসের কিছু অংশ মাত্র কয়েক মিনিট বাঁচে। তবে কয়েকটি আবার পাঁচ দিন পর্যন্ত বাঁচতে দেখা গেছে। খাদ্যের মাঝ দিয়ে ভাইরাসের প্রসার (স্প্র্রেড) দেখা যায় না। তবুও বিজ্ঞানীরা বলেন, শাকসবজি ভালো করে ধুয়ে (রানিং ওয়াটার) খাওয়া ভালো। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মহামারী থেকে বাঁচতে হলে বাড়ির মেঝেসহ অন্যান্য আসবাবপত্রের ওপর স্প্রে করা উচিত। বিশেষ করে বাজার ইত্যাদি থেকে কোনো কিছু বয়ে আনলে হাত অন্তত ২০ সেকেন্ড যেকোনো সাবান দিয়ে ধোয়া উচিত। এই ভাইরাসের প্রসারে কেউ কি লাভবান হচ্ছে? হ্যাঁ হচ্ছে। যদি কেউ প্রাক্তন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার, শিকাগোর মেয়র এবং বারাক ওবামার হোয়াইট হাউজের চিফ অব স্টাফ বাহম ইমানুয়েলের মন্তব্য জেনে থাকেন- তিনি বলেন, ‘কোনো সঙ্কটকে বৃথা যেতে দিও না (নেভার অ্যালাও এ ক্রাইসিস টু গো টু ওয়েট)।’ ইমানুয়েল জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কোটিপতিরা (বিলিয়নিয়ারস) এই মহামারী থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ২৮০ বিলিয়ন ডলার বেশি লাভ করেছেন এমন সময়ে, যখন দেশে (যুক্তরাষ্ট্রে) লাখ লাখ লোক চাকরিচ্যুত হয়েছে এই রোগের কারণে (কারণ লকডাউন, কলকারখানা বন্ধের জন্য)। মানুষ খাবার পর্যন্ত পাচ্ছে না।
শত শত অনুসন্ধানে একটি তথ্য প্রায় এরকম, তা হলো- এটা মানুষের তৈরি প্রকৃত থেকে। চীনের উহানে অবস্থিত গবেষণাগারে এটা পাওয়া যায় এবং এর ওপর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। একপর্যায়ে এটা গবেষণাগার থেকে উহানে ছড়িয়ে পড়ে এবং এ দাবিটি আর কেউ নন, করেছেন ড. লাক মনটেগনিয়ার, যিনি এইচআইভিরও আবিষ্কারক। তিনি ওষুধের ওপর নোবেল পুরস্কারও পান। নানা তত্ত্বের মধ্যে আরো একটি হলো- এইচআইভির টিকা বের করতে গিয়ে এই ভাইরাসের জন্ম হয়। এক টিকাকে অন্য টিকার জেনোমের সাথে মিশিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে এর জন্ম হয়। বিভিন্ন বাদানুবাদের মধ্যে একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তা হলো- জীবাণু ভাইরাস তৈরি বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, এটি ছড়িয়ে দেয়া। এর অনুসন্ধান করে দোষীকে শাস্তি দেয়া উচিত। কেননা উন্নত দেশগুলোতে (চীনসহ) হাজার হাজার গবেষণাগারে যে বিষয়গুলোর ওপর গবেষণা হয়, তা বিস্ময়কর। কিছু কিছু ভয়ঙ্কর। সেগুলো ল্যাবরেটরিতে আবদ্ধ থাকলে আপত্তি নেই। কিন্তু তা ভুলক্রমে ছড়িয়ে পড়লে বা ইচ্ছাকৃতভাবে তা করলে, অবশ্যই তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেননা এগুলো মানবজাতির অবস্থানের প্রতি বিশাল হুমকি। এই করোনার জন্মের জন্য কোনো গবেষণা হয়নি। গবেষণা হয়েছিল এইচআইভির টিকা নিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয় কিছু ভাইরাস চীনের উহানে অবস্থিত গবেষণাগারে পাঠায় টিকা আবিষ্কার বা তৈরির জন্য। ওই গবেষণাগারটিতে যুক্তরাষ্ট্রের বহু বিজ্ঞানীও কাজ করেন।
এখানে মিস শি কোংলি বলে এক চীনা গবেষক এইচআইভির প্রোটিনের দেখা পান বাদুরের দেহে এবং নানা গবেষণা ও কর্মকাণ্ডের মাঝে এ ভাইরাসটি ছিটকে পড়ে। ক্রমে বিস্তার লাভ করে আজ বিশ্বে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। যাই হোক, এ কথা সত্য- বিশ্বের বেশির ভাগ সঙ্কট এবং সমস্যার পেছনে মানুষেরই হাত। তাই ধার্মিকরা বলেন, সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণে রেখে এবং তাঁকে ভয় করে যদি মানুষ মানুষের মঙ্গলের চিন্তা এবং কর্মকে অগ্রাধিকার দিত, তাহলে বিশ্বে এত সঙ্কট সৃষ্টি হতো না। কিন্তু মানুষ আপাত লাভের জন্য সে চিন্তা এবং কর্ম থেকে বিরত থাকে। তবে ফল মানুষকেই ভোগ করতে হয়। এটাও সত্য- বিশ্বে যতবার মহামারী, ধ্বংস এসেছে, সবই এসেছে মানবসমাজ যখন অনাচার-অবিচার যুদ্ধের মাঝে ভয়ঙ্করভাবে জড়িয়ে থাকে। একটু ইতিহাসের দিকে নজর দিলেই বোঝা যায়। ইংরেজ দখলের সময় বেঙ্গলে যে দুর্ভিক্ষ হয় সেখানে জনসংখ্যায় তিন ভাগের এক ভাগ মৃত্যুবরণ করে। অথচ তখন খাবার ছিল প্রচুর। শুধু তা বিতরণ করা হয়নি। তখনকার ইতিহাসটি এমনই। আবার দ্বিতীয়-প্রথম মহাযুদ্ধের মূলেও এই একই কাহিনী। লোভ ও দখলের ইতিহাস। তবে কষ্টের কথা হলো, কিছু দুর্বৃত্তের কারণে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হলেও তারা শুধরে যায় না। আবার নতুনভাবে দুর্বৃত্তায়নে জড়িয়ে পড়ে। ফলে অশান্তি-অনাচারের শেষ হয় না।
এখন মুখোশ পরে কতদূর এই দুর্বৃত্তায়নের রাজ্য থেকে বেঁচে থাকা যাবে সেটাই বড় প্রশ্ন। আগেই বলা হয়েছে, এ ঘটনাগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সৃষ্টিকর্তার সতর্কতা মাত্র। আর সে সতর্কতার দিকে কেউ নজর দেয় না। এখন আন্দোলন হওয়া উচিত, এসব ভয়ঙ্কর জীবাণু ইত্যাদি গবেষণার নামে এর প্রতিষেধক হিসেবে নতুন জীবাণু সৃষ্টি না করা- যা এবার করা হয়েছে। অধ্যাপক মনটেগনিয়ার যেমন আশা করেন, প্রাকৃতিকভাবে অতি শিগগিরই যেন এই মহামারীর অবসান ঘটে। আদতে তেমন গবেষণাই অনুমোদন করা উচিত, যা মানুষের মঙ্গল বয়ে আনে। অন্যথায় এর সাথে জড়িত কেউ না কেউ কখনো ইচ্ছা করে বা কখনো ভুলক্রমে বাইরে ছড়িয়ে দিতে পারে এবং সেই সাথে যুদ্ধবাজদের হৃদয়েও কর্মকাণ্ডের আকাক্সক্ষা জাগে। স্মরণযোগ্য, বিশ্বের সব সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের মূলে শক্তিবানদের এই আকাক্সক্ষা। তাই এই ভাইরাস তাদের সৃষ্ট বলে অনেকেই সন্দেহ করে।