ধাক্কা খেয়েছে ভারতের ইস্পাত শিল্প

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত খবর হয়ে উঠেছে নভেল করোনাভাইরাস। বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থায় অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন এনেছে সংক্রমিত ভাইরাসটি। জানুয়ারিতে ভাইরাসটির বিস্তার ছিল চীনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তখন ভারতের ইস্পাত রফতানিকারকরা ভেবেছিলেন, চীন সংকটে পড়লে তাদের কপাল খুলতে বসেছে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেন তারা। তবে এক মাস না পেরোতেই হিসাব পাল্টাতে শুরু করেছে। ফেব্রুয়ারিতে গত আট মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতো ভারতের ইস্পাত রফতানি খাতে দেখা দিয়েছে নিম্নমুখী প্রবণতা।
চীন বিশ্বের শীর্ষ ইস্পাত উৎপাদনকারী দেশ। গোটা বিশ্বের অর্ধেকের বেশি ইস্পাত উৎপাদন হয় দেশটিতে। ধাতব পণ্যটির রফতানিতেও দেশটি বিশ্বদরবারে প্রথম। জানুয়ারিতে চীন যখন নভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ছে, তখনই খাতসংশ্লিষ্টরা বুঝতে পেরেছিলেন আসন্ন বিপদ সম্পর্কে। এরপর অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ ধারণ করতে শুরু করে। ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশটির এক শহর থেকে আরেক শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া হয়। মানুষের চলাচল, পরিবহন, বাণিজ্য, কলকারখানা সবকিছুতেই সীমাবদ্ধতা টানা হয়। এতে অবশ্য আশার আলো দেখছিলেন ভারতের ইস্পাত রফতানিকারকরা।
চীনের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ইস্পাত উৎপাদনকারী দেশ ভারত। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে প্রতি বছর দেশটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ইস্পাত আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি করে। দেশটির অর্থনৈতিক হালচাল এমনিতেই খুব একটা ভালো নয়। ছয় বছর ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষীণ হয়ে পড়ছে, যা ২০১৯ সালে এসে আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। এ কারণে দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজারেও ইস্পাতের চাহিদা কমতির দিকে রয়েছে। ফলে খাতসংশ্লিষ্টরা পণ্যটির রফতানিতে জোর দিচ্ছিলেন। নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপে শিল্প ধাতুটির রফতানি বাণিজ্যে চীনের অনুপস্থিতি তাদের প্রত্যাশা বাড়িয়েছিল।
মুম্বাইভিত্তিক ইস্পাত কোম্পানি জিএসডব্লিউ স্টিল লিমিটেডের মার্কেটিং ডিরেক্টর জয়নাথ আচার্য জানুয়ারিতে বলেছিলেন, চীন ইস্পাত সরবরাহ করতে পারছে না। দেশটির কারখানা ও বন্দর বন্ধ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে ভারতীয় ইস্পাতের চাহিদা বাড়বে।
তার এ বক্তব্যের সত্যতাও মেলে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (এপ্রিল-জানুয়ারি) ভারত থেকে পরিশোধিত ইস্পাত রফতানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেড়ে ৭২ লাখ টন ছাড়িয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। এ সময় ভারত থেকে রফতানি হওয়া ইস্পাতের শীর্ষ গন্তব্য ছিল ভিয়েতনাম, ইতালি, নেপাল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব।
তবে এক মাসের মাথায় করোনাভাইরাসের বিস্তার বাড়তে শুরু করে। চীন ছাড়িয়ে সংক্রমিত ভাইরাসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কায় দেশে দেশে চিন্তার ছাপ পড়তে শুরু করে। এতে ভারতের ইস্পাত রফতানির চিরাচরিত বাজার ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চাহিদা কমতে শুরু করে। এর প্রভাব পড়ে ভারতীয় ইস্পাত রফতানিতে।
ইন্ডিয়া স্টিল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারত থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে সব মিলিয়ে ৫ লাখ ৭০ হাজার টন পরিশোধিত ইস্পাত রফতানি হয়েছে, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৮ শতাংশ কম। একই সঙ্গে ধাতব পণ্যটি রফতানিতে এটা গত আট মাসের মধ্যে প্রথম পতন। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত থেকে ধাতুটির রফতানির পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ১৯ হাজার টন।
প্রতিষ্ঠানটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অর্ণব কুমার হাজরা বলেন, ভারতের সব রফতানি বাজারে ইস্পাতের চাহিদা উবে গেছে। একই সঙ্গে দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজারেও ধাতুটির চাহিদা ব্যাপক হারে কমেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে ভারতে ইস্পাতের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার কমে চার মাসের সর্বনিম্নে নেমেছে। এ সময়ে পরিশোধিত ইস্পাত উৎপাদন কমে ৮৫ লাখ ৬০ হাজার টনে নেমেছে, যা আগের দুই মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।
তবে এ সময়ে দেশটির অপরিশোধিত ইস্পাত উৎপাদন ১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। ওয়ার্ল্ড স্টিল অ্যাসোসিয়েশনের (ডব্লিউএসএ) তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে ভারতে সব মিলিয়ে ৯৬ লাখ ৬০ হাজার টন অপরিশোধিত ইস্পাত উৎপাদন হয়েছে। আগের বছরের একই মাসে দেশটি উৎপাদন করেছিল ৯৪ লাখ ২০ হাজার টন ইস্পাত।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। ২৪ মার্চ থেকে ভারতজুড়ে ২১ দিনের জন্য সম্পূর্ণ লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সরকার। এ পরিস্থিতি দেশটির ইস্পাত শিল্পের জন্য আরো হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
ব্লুমবার্গ, রয়টার্স ও টাইমস অব ইন্ডিয়া অবলম্বনে