বাঙালি কবি মধুসূদন

0

তাপস মজুমদার ॥ মধুসূদন জন্মেছিলেন ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। লেখাপড়ার হাতেখড়ি গ্রামের পাঠশালায়। তারপর চলে যান কলকাতা। ছাত্রজীবন থেকেই কবি বায়রনের লেখা খুব ভালো লাগত মধুসূদনের। এ কারণে তিনি বায়রনকে অনুসরণ, অনুকরণ করতে পছন্দ করতেন এবং মনে করতেন বায়রনকে অনুসরণ করাটাই জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা ও পরমানন্দ। সে কারণে তিনি জীবনের শুরুতে বাংলা ভাষায় তেমন কিছু লেখেননি বা লিখতে চাইতেনও না। তাঁর ধারণা ছিলো বাংলা ভাষা অশিক্ষিত ও বর্বরের ভাষা। তবুও মধুসূদনের খুব কাছের বন্ধু গৌরদাস বসাকের অনুরোধে বাংলা ভাষায় একটি কবিতা তাঁকে লিখতে হয়েছিলো। কবিতা বর্ষা ঋতু সম্পর্কে। শিরোনাম ‘বর্ষাকাল’। গভীর গর্জ্জন সদা করে জলধর/ উথালির নদনদী ধরণী উপর/। তারপর তিনি আরও কয়েকটি বাংলা কবিতা লিখেছিলেন। তবে তিনি বাংলা ভাষায় কবিতা রচনাতে উৎসাহী ছিলেন না। এ বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলতেন ‘বাংল ভাষা ভুলে যাওয়া ভালো, এ- তো অশিক্ষিতের ভাষা’। সেজন্য আশৈশব মধুসূদনের বিলেত গমনের বাসনা ছিলো। এক সময় তিনি ইংল্যান্ড যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রাখতে পারলেই তিনি তাঁর প্রিয় কবি বায়রনের মতো বিখ্যাত হয়ে যাবেন। মধু কবির এই দৃঢ় আত্মবিশ্বাস তাঁকে জীবনে অনেক দূর নিয়ে যেতে পাথেয় হয়েছিলো। তবে এ কথা চিরন্তন সত্য তিনি যতটা না ইংরেজি কিংবা অন্য কোন ভাষায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন তার ঢের বেশি বাংলাতে। মধুসূদনের যে বাংলা ভাষার প্রতি, জীবনের এক সময় প্রবল অনুরাগ জন্মেছিলো তার প্রমাণ তাঁর মহাকাব্যসহ বিভিন্ন রচনা। ইংল্যান্ড যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি বাংলা ভাষায় লিখেছিলেন ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতায়-‘রেখো, মা, দাসের মনে, এ মিনতি করি পদে / সাধিতে মনের সাধ/ ঘটে যদি পরমাদ,/ মধুহীন করো না গো/তব মনঃকোকনদে। মধুসূদনের যে বাংলার প্রতি , বাংলা ভাষার প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিলো তা আমরা বুঝতে পারি তাঁর রচনা থেকে। এমন কি যখন তিনি ইংল্যান্ড যাওয়ার উদ্দেশ্যে জাহাজে উঠলেন তখনও জাহাজ ছাড়ার সময় জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে টুপি খুলে চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন-‘গু হধঃরাব ষধহফ,এড়ড়ফ হরমযঃ’
মধুসূদন জীবনে আট বছর মাদ্রাজে ছিলেন। সে সময় তিনি বাংলা ভাষায় কারুর সাথে কথা বলতে পারতেন না। কারণ সেখানে কেউ বাংলা জানতো না। ফলে বাঙালি কবি মধুসূদন নিজের ভাষা প্রায় ভুলতে বসলেন। সে সময় তিনি মনে মনে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। বাঙালির ছেলে হয়ে যদি তিনি বাংলা ভুলে যান তাহলে লোকে তাঁকে হেয় করবে। তিনি কলকাতা থেকে মহাভারত আর কৃত্তিবাস রামায়ণ এনে পড়তে শুরু করলেন এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন বাংলা ভাষাতেই তিনি বড় হবেন। আর এ বাংলা ভাষাকেই বড় করবেন, বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করবেন। এ ভাষার ছন্দের যাদুতে মুক্ত হবে জাতি। তাই তিনি প্রিয় বন্ধু গৌরদাস বসাক এর উৎসাহে অত্যন্ত আগ্রহ ও পরিশ্রমে বাংলা ভাষায় অনুশীলন শুরু করলেন। মধুসূদনের প্রথম জীবনে যে ভুল ধারণা ছিলো সে ভুল ভাঙার পর আফসোস করে মাতৃভাষার উদ্দেশ্যে লিখলেন- ‘হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন,/ তা সবে, অবোধ আমি অবহেলা করি-/ পরধন-লোভে মত্ত,করিনু ভ্রমণ / পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি। যে মানুষটি বাংলার কথা শুনলে নাক সিঁটকাতেন, নিন্দা করতেন, ঘৃণা করতেন, এমনকি বন্ধুদের কাছে বলতেন-“ বাংলা ভাষা হচ্ছে বর্বরের ভাষা, ইতরের ভাষা, অসভ্যের ভাষা’ সেই মানুষটির আমূল পরিবর্তনে বাংলা সাহিত্যে যেমন লাগল আধুনিকতার ছোঁয়া ঠিক তেমনি মধুসূদনও পেলেন এক নতুন জগতের সন্ধান। তাই তিনি পরম আনন্দে বই লিখে চললেন ভিন দেশি কোন ভাষায় নয়, তাঁর মাতৃভাষা বাংলাতে। জীবনের এক সময় যিনি বাংলা ভাষাকে অবহেলা করেছিলেন সেই মধুসূদনের বাংলা ভাষার ছলাকলায় মুগ্ধ হলো তৎকালীন বিজ্ঞমহল। তিনি সবকিছুকে বাদ দিয়ে লিখতে লাগলেন বইয়ের পর বই। ‘পদ্মাবতী’ ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ এর আগে তিনি লিখলেন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ’। তাঁর এই প্রহসন দুখানা নিয়ে অনেক বড় বড় সমালোচক বলেছিলেন-‘একেই কি বলে সভ্যতা’ বাংলাদেশের একটি সর্বোৎকৃষ্ট প্রহসন। বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার প্রবর্তক মধুসূদনের বাংলা ভাষায় বই লিখতে লিখতে এক সময় প্রবল আত্মবিশ্বাস জন্মে গেল। তিনি অত্যন্ত গর্বের সাথে বললেন-‘আমার প্রতিটি বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি যদি জনসাধারণের কাছে অকুন্ঠ প্রশংসা না পাই, তবে আমি এইসব বই আগুনে পুড়িয়ে ফেলব।’ কিন্তু প্রকৃত সত্য কোন বই-ই মধুসূদনকে আগুনে পোড়াতে হয়নি। তিনি তাঁর প্রতিটি রচনাতে অকুন্ঠ প্রশংসা লাভ করেছেন। মধুসূদন যখন উপলব্ধি করলেন তাঁর জন্মভিটা সাগরদাঁড়ির অতুলনীয় সৌন্দর্য তখন তিনি তাঁর জন্মভূমি সাগরদাঁড়ি সম্পর্কে বলেছেন- ‘এই মধুমাখা স্থানে আসলে যেমন আনন্দ পাওয়া যায়, পৃথিবীর আর কোন স্থানে গেলো সেরকমটি আর পাওয়া যায় না’। যে নদে তিনি সাঁতার কেটে শিশু বয়স পার করেছেন সে কপোতাক্ষ নদ সম্পর্কে বলেছেন-‘কপোতাক্ষ তোমার তীরে পাতার কুটিরে যে বাস করিতে পায় সেও পরম সুখী।’ শুধু তাই নয় সুদূর ফরাসি দেশ থেকে কপোতাক্ষ নদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন- ‘সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে/ সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে’। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিচিত্তে মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি যে দরদ ও হৃদয়ের প্রবল ভালবাসা ছিল তার স্বদেশ প্রীতি ও মাতৃভাষার অনুরাগ মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা মেঘনাদবধ কাব্যে- জন্মভূমি রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে / যে ডরে, ভিরু সে মূঢ়, শত ধিক তারে!’ মধুসূদন অতি অল্প সময় বাংলা সাহিত্যের সেবা করে এবং অল্প সংখ্যাক গ্রন্থ রচনা করে মাতৃভাষার যে উন্নতি সাধন করেছেন, তাতে তাঁর সাথে এ দেশের অন্য কোন কবির তুলনা হয় না। তিনি তাঁর বহুমুখী প্রতিভা দ্বারা বাংলা সাহিত্যে যে উৎকর্ষসাধন করেছেন তাতে বাংলা ভাষার ইতিহাসে তাঁর স্থান চিরদিনের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে আছে। মহাকাব্যের সেই কবির ১৯৬ তম জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
প্রভাষক, লেখক ও প্রাবন্ধিক।