চট্টগ্রামে ভোট যেভাবে

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ আগের দিন রাত ১১টা থেকে ভোটকেন্দ্রগুলোতে শুরু হয় থেমে থেমে ককটেল বিস্ফোরণ। সোমবার সকাল থেকে হামলা, মারধর, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও গোলাগুলি। এর মধ্যে হয়েছে চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণ। ভোটকেন্দ্র থেকে বিএনপি’র প্রার্থীর এজেন্ট বের করে দেয়া, বিএনপি’র সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়া, মারধর, হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মহানগরীর নসিমন ভবনে বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে ভোটগ্রহণ স্থগিত করে পুনঃনির্বাচনের দাবি জানান বিএনপির প্রার্থী আবু সুফিয়ান।
তিনি বলেন, ১৭০টি কেন্দ্রের মধ্যে অলমোস্ট সব কেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। ভোটারদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। গোপন বুথে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা ভোট দিচ্ছে।
এসব কারণে ভোট স্থগিত করে পুনরায় ভোটের আবেদন করছি। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি শাহাদাত হোসেন বলেন, আমরা বলেছি, প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রতি কেন্দ্রে ৫০০-১০০০ লোক অবস্থান নিয়েছে। আপনারা দেখেছেন কিছু ছেলে লাইন ধরে ভোট দিচ্ছে। সেখানে বয়স্ক, মধ্যবয়স্কদের দেখা যায়নি। সেখানে সবগুলো দলীয় এবং বাইরের ছেলে। শাহাদাত হোসেন বলেন, প্রহসনের নির্বাচনকে ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে দেখানোর জন্য এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। ১১টা ৩৫ মিনিটে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানিয়েছি ১২০টি কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। তিনি ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলেও এখনো কিছু করেননি। বিএনপি সভাপতি শাহাদাত বলেন, প্রতি ভোটকেন্দ্রে সেনা সদস্য থাকবে বলেছিলেন সিইসি ও ইসি। এখন বলছেন সেনা সদস্য আছেন কারিগরি ত্রুটির জন্য, ভোটের পরিবেশের জন্য নয়।
সোমবার সকাল ৯টা থেকে সবগুলো কেন্দ্রেই ইলেকট্রনিক্স ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ শুরু হয়। এরমধ্যে শুরুতেই চাঁন্দগাঁও এলাকার এনএমসি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে পুলিশ-বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এছাড়া চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, ফরিদের পাড়া ও সমশের পাড়া ভোটকেন্দ্রে রোববার রাত ১১টা থেকে থেমে থেমে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ভোটগ্রহণের শুরুতে চট্টগ্রাম মহানগরীর ষোলশহরের হাসান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গোলাগুলি, ককটেল বিস্ফোরণ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের উপর হামলার অভিযোগ করেন নগর বিএনপির যুগ্ম সমপাদক আনোয়ার হোসেন লিপু। তিনি বলেন, সকাল ১০টার দিকে হাসান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গোলাগুলি ও হামলায় আমাদের দলের দুইজন আহত হয়। এরমধ্যে খোরশেদ আলম নামে একজন গুরুতর জখম হয়েছে। তার চোখ ও উরুতে কুপিয়ে জখম করা হয়। এসময় কেন্দ্রে ঢুকে আমাদের এজেন্টেদেরও বের করে দেয়া হয়েছে।
এদিকে, বোয়ালখালী উপজেলার বিভিন্ন কেন্দ্র, নগরীর রাবেয়া বশর ইনস্টিটিউট ও আল হুমায়রা মহিলা মাদরাসা কেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্টদের আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থকেরা মারধর করে বের করে দেয়। এসব কেন্দ্রে ভোট বর্জন করেছে বিএনপি সমর্থকরা। বোয়ালখালী উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আতিক উল্লাহ জানান, বোয়ালখালীর পূর্ব খিতাপচর রশিদ প্রাথমিক বিদ্যালয়, খিতাপচর ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেঙ্গুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোমদন্ডী বুড়ি পুকুর পাড় আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট বর্জন করে চলে গেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এসব কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্টদের পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বের করে দিয়েছে বলে জানান, ছাত্রদল নেতা আতিক। তিনি বলেন, বোয়ালখালীজুড়ে বহিরাগতরা অবস্থান নিয়েছে। সরোয়াতলীর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলায় আমাদের দুইজন কর্মী আহত হয়েছেন।
বোয়ালখালীর আকুবদন্ডী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে বিএনপির সমর্থক ভোটারদের প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ভোট শুরুর কিছুক্ষণ পর ওই কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন পোপাদিয়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সালেহ জঙ্গি। তিনি অভিযোগ করেন, সকাল থেকেই আকুবদন্ডী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়েছেন। তারা আমাদের দলের নেতাকর্মীদের বের করে দিয়েছেন। তাদের পছন্দমতো মানুষ ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করিয়েছেন। বিএনপির সমর্থক ভোটারদের কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি।
চান্দগাঁও থানার খাজা রোডে ভোটের শুরুতেই একদল যুবককে শোডাউন করতে দেখা গেছে। এসময় তাদের হাতে ছিল লাঠি ও কিরিচ। কারও কারও মুখ ছিল রুমাল দিয়ে বাধা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভোটকেন্দ্রের সামনে মারমুখী যুবকদের আচমকা অবস্থানে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ভোটকেন্দ্রগুলোতে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতিও কম দেখা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (উত্তর) উপ-কমিশনার বিজয় বসাক বলেন, নির্বাচনে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। তবে বোমাবাজি বা ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগ সঠিক না। আমার কাছে এরকম কোনো তথ্য নেই। যেকোনো ধরনের সংঘাত ঠেকানো এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নেওয়া আছে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক ছিল। আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোছলেম উদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, বিএনপি আসলে আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচন করছে। তাদের কাজই হলো অভিযোগ করা। এখন পর্যন্ত কোথাও কারচুপির কোনো ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচনে ভরাডুবি হবে বুঝতে পেরে বিএনপির প্রার্থী এসব অভিযোগ করছে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। এতে যে ফলাফল আসবে আমি তা মেনে নেবো। চট্টগ্রাম জেলা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা হাসানুজ্জামানও বলেন একই কথা। তিনি বলেন, ইভিএম মেশিনে ভোটগ্রহণে কোন কারচুপি হয়নি। ভোট সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। কোথাও কোন গণ্ডগোল হয়নি।
ইভিএমের গোপন কক্ষে যেভাবে চালানো হয় জবরদস্তি
৬৬ বছর বয়সী ভোটার মোহাম্মদ রফিক। ভোট দিতে কেন্দ্রে যাওয়ার পর সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার তার স্মার্ট কার্ড চেয়ে নেন। কার্ড ইভিএমএ প্রবেশ করাতেই রফিকের ভোটার সমপর্কিত সব তথ্য স্ক্রিনে ভেসে উঠে। এরপর রফিকের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে ভোটার শনাক্তকরণ নিশ্চিত করতেই একজন গোপন বুথে প্রবেশ করে ভোটটি দিয়ে দেয়। রফিককে জানানো হয় তার ভোট হয়ে গেছে। মোহাম্মদ রফিক চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, টিপ দি, আঁর কার্ড ইয়্যান মেশিনর ভিতর দিইয়ে। আঁরে হয়দে তোঁয়ার ভোট হয়ে গেইয়্যি। তুই জ গই। কিছুই বুঝতে না পেরে রফিক বললেন, মার্কা ত ন দেহি, ভোট ক্যানে অইলো। এই হতা হইতেই জোর গরি বাইর গরি দিইয়্যি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার সিডিএ পাবলিক স্কুল ভোটকেন্দ্রের আরেক ভোটার বলেন, গোপন কক্ষে একটা ছেলে গেছে আমার সাথে। উনি বলে, এইখানে নৌকায় মারো। আমি বললাম, আমি নৌকায় কেন মারবো। আমি যেখানে খুশি সেখানে মারবো। এটা তো আমার ব্যাপার। আমি ভোট দেবো, আমিই দেখবো। এ কথা বলায় সে আমাকে মারার ভয় দেখাল।
চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন পৃথক দুটি কেন্দ্রের এই দুই ভোটার এভাবেই জানালেন ইভিএমে কিভাবে ভোট নেওয়া হচ্ছে সেই চিত্রের খানিকটা।
স্থানীয়রা জানান, ভোটগ্রহণের শুরু থেকে প্রকৃতপক্ষে চান্দগাঁও-বোয়ালখালী নির্বাচনী আসনের প্রায় সব কেন্দ্রই ছিল আওয়ামী লীগ কর্মীদের দখলে। কেন্দ্রের বাইরে ভোটারদের লাইন থেকে দেখে দেখে লোক নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছেন আওয়ামী লীগ কর্মীরা। এরপর ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। প্রতিটি বুথ তদারকি করছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর একাধিক কর্মী। একাধিক ভোটারকে ভোট দানের গোপন কক্ষে নিয়ে গিয়ে তাদের সামনে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইভিএম মেশিনের সবুজ বোতাম তারাই চেপে দিয়েছেন। এর মধ্যেই ভোটারদের যারা এভাবে ভোট দিতে অসম্মতি প্রকাশ করেছেন, তাদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে গোপন কক্ষের ভেতরেই। সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্রের অদূরেই জটলা বেঁধে অবস্থান করে নৌকার কর্মীরা। তারা ভোটারের পরিচিতি নিশ্চিত হয়েই কেন্দ্রে ঢুকতে দিচ্ছে। কেউ যদি ভোট নিজের অধিকার জানিয়ে ভোট দিতে যেতে চান তখনই মারধর করা হয়। নৌকায় ভোট দেবে কিনা সেটা নিশ্চিত হয়েই কেন্দ্রে যাওয়ার অনুমতি পায় ভোটাররা। বাধা দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলা হচ্ছে, ওপরের নির্দেশ নৌকা ছাড়া কেউ যেতে পারবে না।