গা শিউরে ওঠা নৃশংসতায় হত্যা করা হয় আনারকে

0

আসিফ কাজল, ঝিনাইদহ ॥ পৃথিবীর সব নৃশংসার কাছে হার মেনেছে এমপি আনার হত্যাকাণ্ড । পুলিশ ও গোয়েন্দারা যতই গভীরে যাচ্ছেন ততই নৃশংসতার ভয়াবহতা পাচ্ছেন। খুনিদের মুখে এই বর্বরতার কথা শুনে তদন্ত কর্মকর্তাদেরও গা শিউরে উঠছে। হত্যার পর শরীরের চামড়া ছিলে শরীর টুকরো টুকরো করা হয়। ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীভা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে যাওয়ার পর তিনি আর জীবিত ফিরতে পারেননি। বের হয়েছেন খন্ড খন্ড কিমা হয়ে ট্রলি আর পলিথিন ব্যাগে। পুরো কিলিং মিশনে সবার সামনে ছিলেন শিমুল ভূঁইয়া ওরফে সৈয়দ আমানুল্লাহ। হত্যার পর তার হাত-পাসহ শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে আলাদা করে হত্যাকারীরা। ৫৮ সেকেন্ডের একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
ফুটেজটিতে দেখা যায়, ভারতীয় সময় ১৪ মে বিকেল ৫টা ১১ মিনিটের দিকে দুজন ব্যক্তি একটি পেস্ট কালারের ট্রলি ব্যাগ ও তিন থেকে চারটি পলিথিন ব্যাগে আনারের মরদেহ গুম করার জন্যে লিফটে উঠছেন। ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, সঞ্জীভা গার্ডেনসের ফ্ল্যাট থেকে যে দুজন বের হয়েছেন তারা হলেন- শিমুল ভূঁইয়া ওরফে সৈয়দ আমানুল্লাহ ও সিয়াম ওরফে কসাই জিহাদ। সিসি ক্যামেরায় যা দেখা গেছে তা স্বীকারও করেছেন ডিবির হাতে গ্রেফতার আমানুল্লাহ। অন্যদিকে ভারতীয় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন কসাই জিহাদ। তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবির একজন কর্মকর্তারা জানান, এমপি আনারকে হত্যার বিস্তারিত বর্ণনা শুনে তারা নিজেরাই আঁতকে ওঠেন। তার পুলিশি ক্যারিয়ারে অনেক খুনের ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন। কিন্তু এত নৃশংস বর্ণনা কখনোই শোনেননি।
জিজ্ঞাসাবাদে শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ জানিয়েছেন, কীভাবে এমপি আনারকে বালিশচাপা দিয়ে হত্যার পর হাত-পাসহ শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আলাদা করা হয়। যেন কোনোভাবেই আনারের চেহারা দেখে কেউ পরিচয় শনাক্ত করতে না পারে, সেজন্যেই খুনিরা এ পরিকল্পনা করে। এরপর ট্রলি ও ব্যাগে করে শরীর খন্ড খন্ড করে কিমা বানিয়ে লাশের টুকরো টুকরো অংশ বের করে নেওয়া হয়।
আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভুঁইয়া ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানিয়েছেন, আনোয়ারুল আজীম আনারকে সঞ্জীভা গার্ডেনের ফ্ল্যাটে হত্যা করা হয়। হত্যার পর শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে আলাদা করা হয়। এরপর একটি ট্রলি ও তিন-চারটি পলিথিন ব্যাগে করে ১৪ মে বিকেল ৫টা ১১ মিনিটের দিকে সেসব টুকরো বের করা হয়। এরপর এগুলো ফেলে দেওয়া হয় কলকাতার হাতিশালা বর্জ্য খালে। আমানের স্বীকারোক্তির পর ভারতীয় পুলিশ ২৩ মে রাতে হাতিশালা বর্জ্য খালে তল্লাশি চালায়। তবে অন্ধকার হওয়ায় সেদিন মরদেহ খুঁজে পায়নি পুলিশ। পরেরদিন ২৪ মে আবারও খ- লাশের সন্ধান শুরু করে ভারতীয় পুলিশ। ডিবির দাবি, যেহেতু হত্যাকা-ে সরাসরি বেশ কয়েকজন আসামি গ্রেফতার রয়েছেন এবং তথ্য দিয়েছেন সেহেতু লাশের সন্ধান মিলবেই।
ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার গ্রেফতারের পর জিহাদ জিজ্ঞাসাবাদের মুখে এমপি আনার হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন। সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে জিহাদ বলেছেন, প্রথমে আনারকে শ্বাসরোধে খুন করা হয়। তারপর দেহ টুকরো টুকরো করা হয়। হাড় এবং মাংস আলাদা করা হয়। চামড়া ছাড়িয়ে তাতে হলুদ মাখান অভিযুক্তরা, যাতে বাইরে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলা যায়, রান্না করার জন্যে মাংস নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার গ্রেফতারের পর জিহাদকে একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আনারকে খুনের পর সেখানেই দেহাংশ ফেলা হয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এসেছে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে সেখান থেকে কোনো দেহাংশ মেলেনি। ২৪ বছর বয়সী জিহাদ হাওলাদার বাংলাদেশের খুলনার বাসিন্দা। অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশ করেছিলেন তিনি। আনারকে খুনের প্রায় দুই মাস আগে জিহাদকে মুম্বাই থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন হত্যাকারীরা।
গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা জানান, হত্যাকান্ডে জড়িত ফয়সাল ও মোস্তাফিজুরের দুটি পাসপোর্টই চলতি বছরের ৮ এপ্রিল ঢাকার বিভাগীয় পাসপোর্ট কার্যালয় থেকে ইস্যু করা হয়। পাসপোর্টে ফয়সালের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে খুলনার ফুলতলা থানার অলকা গ্রাম এবং মোস্তাফিজুরের স্থায়ী ঠিকানা খুলনার ফুলতলার যুগনীপাশা গ্রাম উল্লেখ করা হয়েছে। আমান ওরফে শিমুল ভুঁইয়া মোস্তাফিজুর ও ফয়সালকে পাসপোর্ট বানিয়ে দেন। তবে দুজনেরই বর্তমান ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ঢাকার ক-৩২/১২ নদ্দা।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এমপি আনারকে কলকাতায় হত্যার পরিকল্পনা সাজিয়েই মোস্তাফিজ ও ফয়সালের পাসপোর্ট করানো হয়। ভারতীয় ভিসা সংগ্রহ করে ১১ মে কলকাতায় প্রবেশ করেন তারা। হত্যাকান্ড শেষে ১৭ মে মোস্তাফিজ ও ১৮ মে ফয়সাল দেশে ফিরে আসেন। সবশেষে বাংলাদেশি ও ভারতীয় গোয়েন্দা তথ্যমতে এমপি আনার হত্যার মূল পরিকল্পনায় ছিলেন তারই বাল্যবন্ধু এবং আমেরিকা প্রবাসী আক্তারুজ্জামান শাহীন। শাহীনের সঙ্গে আজীমের অবৈধ সোনার ব্যবসা ছিল। দুবাই কেন্দ্রিক সোনার ব্যবসায় শাহীনের বিনিয়োগ রয়েছে। দুবাই থেকে আসা সোনা আজীম ভারতে বিভিন্নভাবে সরবরাহ করতেন। আনারের কলকাতার ব্যবসায়ী বন্ধু গৌতম বিশ্বাস সেই সোনার ক্রেতা ছিলেন। সূত্রটি জানিয়েছে, কলকাতায় চিকিৎসার নাম করে আনার সেখানে গেলেও, আসলে তিনি সেখানে কোনো চিকিৎসা করাননি। এই কথা বলে তিনি কলকাতা যান। শাহীনের সঙ্গে তার সোনার ব্যবসা নিয়েই দ্বন্দ্ব হয়। এই দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করেই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। এদিকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন ঘটনার পর একাধিক দেশ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন। ফলে আনারের মরদেহের মতো তিনিও রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।