শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আ.লীগ নেতাদের কোটি কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য * লোভনীয় হয়ে পড়েছে সভাপতির পদ * বাড়ছে দলীয় কোন্দল, খুন জখম * টাকার জোরে নিয়োগ পাচ্ছে অযোগ্যরা

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য হচ্ছে। সিংগভাগ টাকাই চলে যাচ্ছে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির পকেটে। প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক আওয়ামী লীগ নেতারা সভাপতি হয়ে নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে এই বাণিজ্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এ অভিযোগ করেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী বর্তমানে দুভাবে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ হচ্ছে। একটি জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরটিএ) মাধ্যমে। আরেকটি মাধ্যমিক পর্যায়ে ম্যানেজিং কমিটি ও কলেজ পর্যায়ে গভর্নিং বডির মাধ্যমে। প্রধান, সহকারী প্রধান ও পিয়ন-কেরানি মিলে কমপক্ষে ৫টি পদে কমিটিকে নিয়োগ দানের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
ফলে, এই কমিটি এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাধর। তারা যাকে ইচ্ছে, তাকে অতি সহজে নিয়োগ দিতে ও অর্থ হাতিয়ে নিতে পারে। চাকরির খাতিরে ভুক্তভোগীরা টাকা দেয়ার বিষয়ে মুখ খোলে না। প্রশাসনও ব্যবস্থা নিতে পারে না। নাম গোপন রাখার শর্তে স্কুল-মাদ্রাসার একাধিক প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে এখন যোগ্য তাকে প্রাধান্য দেয়া হয় না। দর কষাকষি করে যে যতো বেশি টাকা দিতে পারে, তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। আগে এটা নেয়া হতো ডোনেশনের নামে। এখন সেটা নেই। ক্ষমতার দাপটে সভাপতির একক সিদ্ধান্তে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হচ্ছে এবং তাদের কাছ থেকে যতো টাকা নেয়া হচ্ছে, তার সিংহভাগ চলে যাচ্ছে সভাপতির পকেটে। সূত্র মতে, এখন ১৫ লাখ টাকার নিচে একজন পিয়নও নিয়োগ পাচ্ছে না। সুপার বা প্রধান শিক্ষক পদে লাগছে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ চাকরির দুর্মুল্যের বাজারে একজন সভাপতি তার মেয়াদকালে তিনজনকে নিয়োগ দিতে পারলে তার পকেটে সহজেই ৫০ লক্ষাধিক টাকা এসে যায়। শিক্ষাঙ্গনের এই নিয়োগ বাণিজ্য এখন আর গোপন নেই। সম্পূর্ণ ওপেন সিক্রেট বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সবাই জানে টাকা ছাড়া চাকরি হবে না। তাই, বেকাররা জমি, জায়গা বিক্রি করে টাকার বান্ডিল পকেটে নিয়ে সভাপতির কাছে ধর্ণা দেয়। এ প্রতিযোগিতায় কোন যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। যে বেশি টাকা দিতে পারে সেই নিয়োগ পায়। ফলে, টাকার বিনিময়ে নিয়োগ পাওয়ার পরও কেউ মুখ খোলে না। কোন অভিযোগ করে না। প্রশাসনও নিয়োগ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। তাছাড়া ক্ষমতাসীন দল ও স্থানীয় এমপির সমর্থন ছাড়া সভাপতি হওয়া যায় না। এভাবে একদিকে প্রশাসনের নিরবতা আরেকদিকে ক্ষমতার দাপট। এই দুই অস্ত্র বলে ম্যানেজিং কমিটি শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে নির্বিঘ্নে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। যা অন্য ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে না। ফলে, সভাপতির পদটি এখন অবৈধ অর্থ আয়ের নিরাপদ ও লোভনীয় পদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেটি বাগিয়ে নিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক আওয়ামী লীগ নেতারা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। অনেক এলাকায় হুমকি-ধামকি ও খুন জখমের ঘটনা ঘটছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ি ম্যানেজিং কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৩ জন। এদের ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হবার কথা। কিন্তু তা হয় না। এমপির পছন্দের ব্যক্তিকে সভাপতি নিয়োগ করে শিক্ষাবোর্ড। ক্ষমতাসীন দলের নেতা ছাড়া এই পদে কেউ আসতে পারেন না।
শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করে নিয়োগ বোর্ড। এই বোর্ডে দুজন সরকারি প্রতিনিধি থাকেন। একজন ডিজির প্রতিনিধি, আরেকজন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। কিন্তু সভাপতির দাপটে তারা স্বাধীনভাবে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দানের ভূমিকা রাখতে পারেন না। ভুক্তভোগী একাধিক প্রধান শিক্ষক জানান সভাপতি আগেই চাকরি প্রত্যাশিদের সাথে যোগাযোগ ও দর কষাকষি করে নিয়োগের বিষয়টি ফাইনাল করে ফেলেন। বোর্ড গঠন বা পরীক্ষা আইওয়াশ মাত্র। এভাবে নিয়োগ দিয়ে দুই সরকারি প্রতিনিধিকে কিছু টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেন। আগে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে আদায়কৃত টাকার একটি অংশ প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হতো। এখন খুচরা খরচ বাবদ দিয়ে পুরো টাকাটাই চলে যায় সভাপতির পকেটে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেছেন, জামিয়াতুল মুদার্রেসিনের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও যশোর জেলা সভাপতি মাওলানা নুরুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, ম্যানেজিং কমিটির সব সভাপতিই আওয়ামী লীগের লোক। তাই, ক্ষমতার দাপটে তারা একেকজন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে ১৫ থেকে ২৫ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি যশোর সদর উপজেলা শাখার সভাপতি ওসমান গণি বলেছেন, নিয়োগ বাণিজ্যের কোন তথ্য প্রমাণ নেই। তাই, বলবো স্বচ্ছভাবে নিয়োগ হচ্ছে। নিয়োগ বোর্ডের সরকারি প্রতিনিধি যশোর সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার রবিউল ইসলাম বলেছেন, আমি নিয়োগ বোর্ডের সদস্য। কাউকে নিয়োগ দিয়ে টাকা নেই না। ম্যানেজিং কমিটির কী করে তা আমার জানা নেই।
সভাপতি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহসান হাবীব নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়ে বলেন, অনেক সময় অনেক কথা শোনা যায়। তা নিয়ে কিছু বলা বা করা আমার এখতিয়ার বহির্ভুত। তবে, ম্যানেজিং কমিটির বিরুদ্ধে কোন লিখিত অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখবো।