ভয়াবহ অর্থ সংকটে , বন্ধ হতে পারে আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ভয়াবহ অর্থ সংকটে পড়েছে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। এ খাতে সরকারের কাছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বা ৪১ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এ অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় জ্বালানি কিনতে পারছে না সরকার। ফলে লোডশেডিং বেড়েই চলছে।
অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে না পারলে বিদ্যুতের লোডশেডিং আরও বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি চাহিদামতো জ্বালানি তেল ও গ্যাস সরবরাহেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলায় সময়মতো অর্থের সংস্থান না করার কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বকেয়া পরিশোধের অর্থ ও ডলারের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে দফায় দফায় চিঠি দিয়ে, আলোচনা করেও তেমন একটা সুফল মিলছে না। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে প্রতিষ্ঠান দুটি বলছে, বিভিন্ন খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এখানে গাফিলতির কোনো সুযোগ নেই।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ অনাকাক্সিক্ষত লোডশেডিংয়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সবাইকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘করোনা মহামারী-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের জ্বালানির মূল্য অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ডলারের মান বেড়ে যাওয়া ও অন্যান্য কারণে যে সংকট তা এখনো চলমান। খুব দ্রুতই জনজীবনে স্বস্তি ফেরাতে কাজ করছে সরকার। আশা করি সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।’
বর্তমানে দেশে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু জ্বালানির অভাবে চাহিদার তুলনায় অন্তত সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জ্বালানির অভাবে বাধ্য হয়েই দিতে হচ্ছে লোডশেডিং। এতে শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
কয়লার অভাবে দেশের সবচেয়ে বড় ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা বন্ধ হয়ে গেছে গত সোমবার। পিডিবির কাছে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এ কেন্দ্রটির কয়লা সরবরাহ বাবদ ৩০০ মিলিয়ন ডলার বকেয়ায় থাকায় চীনা প্রতিষ্ঠান কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এতে আগে থেকে চলমান লোডশেডিং ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
কয়লার অভাবে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চালুর ২৩ দিনের মাথায় গত ১৪ জানুয়ারি বন্ধ হয়ে যায়। কয়লা আমদানির পর গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট পুনরায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর পর ২৩ এপ্রিল থেকে একই কারণে আবার প্রায় ২২ দিন কেন্দ্রটি বন্ধ ছিল। বর্তমানে কয়লার যে মজুদ আছে, তা দিয়ে সপ্তাহখানেক চলতে পারে। আগে কেন্দ্রটি ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করলেও কয়লা সংকেটর কারণে সরবরাহ করছে ৪০০ মেগাওয়াট। এর আগে বরগুনায় অবস্থিত বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি প্রায় দুই মাস ধরে বন্ধ ছিল কয়লা সংকটের কারণে।
রামপাল কেন্দ্র পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সৈয়দ আকরাম উল্লাহ বলেন, ‘সাত দিনের মতো কয়লা মজুদ আছে। আরেকটি জাহাজ বুধবার চট্টগ্রামে এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। কয়লার স্বল্পতা থাকায় কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। যাতে কেন্দ্র বন্ধ না হয়।’
তিনি বলেন, উৎপাদন ঠিক রাখতে একটা জাহাজ পৌঁছানোর আগেই আরেকটির জন্য অর্ডার দিতে হয়। সেজন্য কয়লা আমদানি করতে এলসি খুলতে ব্যাংকে আবেদন করা হয়েছে। পিডিবির কাছে বকেয়া বিল পাওয়ার পর এলসি খোলা যাবে। সাধারণত কয়লা আমদানির এক মাসে আগে বিলের বিষয়টি নিশ্চিত করা না হলে সময়মতো কয়লা আনা যায় না। পিডিবি থেকে অর্থের নিশ্চয়তা না পেলে কয়লা আমদানি করা সম্ভব হয় না। পিডিবি বলেছে কিছু পেমেন্টে করবে। সেটা যদি না করে তাহলে রিস্কে পড়ে যাব।
সরকারের কাছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের প্রায় সাত মাসের বিল বাবদ ২ হাজার মিলিয়ন ডলার বকেয়া থাকায় তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনও অর্ধেকে নেমেছে। দ্রুত তাদের পাওনা দেওয়া না হলে উৎপাদন আরও কমবে।
সূত্রমতে, অর্থ বিভাগ থেকে সময়মতো বরাদ্দ না পাওয়ায় পিডিবি বেসরকারি মালিকদের বিল দিতে পারছে না। বকেয়া বিল দ্রুত পরিশোধের পাশাপাশি বিলের ওপর সুদ বাবদ সরকারের কাছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা দাবি করেছে তারা।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসেসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারব ততদিন পর্যন্ত চালিয়ে যাব। কিন্তু আমাদেরও তো একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের বাকি দেওয়ার সক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। শুনেছি কিছু টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু ৫০০ বা ১ হাজার কোটি টাকা দিয়ে তো কিছু হবে না। অন্তত ৫ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা দরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা না পেলে পিডিবি কিছুই বলতে পারবে না।’
এদিকে ডলার সংকটে আমদানিকৃত জ্বালানির মূল্য পরিশোধে জটিলতার কারণে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে তেল পাঠানো কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তেলবাহী কার্গো না পাঠানোর হুমকি দিয়েছে। এর ফলে জ্বালানির মজুদ বিপজ্জনভাবে কমে আসছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে এক চিঠিতে বিপিসি জানিয়েছে, ডলার স্বল্পতা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ না করায় যথাসময়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে আমদানি মূল্য পরিশোধ করা যাচ্ছে না। বিপিসির কাছে তেল সরবরাহকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ কোটি ডলার।
বিপিসি জানায়, বকেয়া পরিশোধ না করার কারণে গত মাসে ৩০ হাজার টন ডিজেল কার্গো বাতিল করে ভিটল সিঙ্গাপুর। চলতি মাসে ১৫০ হাজার টন ডিজেল এবং ৫০ হাজার টন ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করবে না বলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে। এমন একাধিক কোম্পানি তেল সরবরাহ করতে আপত্তি জানিয়েছে। পেট্রোবাংলা সূত্রমতে, খোলা বাজারে বর্তমানে এলএনজির দাম অনেক কমে গেলেও বিল পরিশোধে জটিলতার কারণে এ সুযোগ নিতে পারছে না সরকার। বর্তমানে খোলা বাজার থেকে এলএনজি আমদানি বাবদ ১১৫ মিলিয়ন ডলারও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় আমদানিকৃত এলএনজি বাবদ ১৪২ মিলিয়ন ডলার বিল বকেয়া পড়েছে। এ ছাড়া এলএনজি আমদানির পর তা গ্যাসে রূপান্তর করার ব্যয় বাবদ বকেয়ার পরিমাণ আরও ১১ মিলিয়ন ডলার।
এদিকে দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত বিদেশি কোম্পানির বিল পরিশোধ করতেও হিমশিম খাচ্ছে সরকার। মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে দেশীয় গ্যাসের অন্তত ৬০ শতাংশ আসে। এজন্য শেভরনকে প্রতি মাসে প্রায় ৫ কোটি ডলার পরিশোধ করার কথা থাকলেও ডলার সংকটের কারণে তা ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না পেট্রোবাংলা। বর্তমানে পেট্রোবাংলার কাছে শেভরনের পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২০ মিলিয়ন ডলার। চুক্তি অনুযায়ী বকেয়া পরিশোধে ৩০ দিনের বেশি দেরি হলে পেট্রোবাংলাকে জরিমানা গুনতে হবে।
সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাস সরবরাহ বাবদ বকেয়া পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০৬ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া সরকারি কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পিডিবির কাছে বিক্রি বাবদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাওনা প্রায় ৫২৫ মিলিয়ন ডলার দাঁড়িয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনোভাবেই এ খাতকে অবহেলার সুযোগ নেই। বিদ্যুৎ, জ্বালানির সংকটে অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হবে। কিন্তু জ্বালানি আমদানিতে অর্থ ছাড় করতে দেরি হওয়ার পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। একটি যারা ডলার ছাড় করছেন তারা বিদ্যুৎ খাতের গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না অথবা দেশের পরিস্থিতি আসলেই ভয়াবহ। তবে দেশের উন্নয়নে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতকে অবশ্যই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জাকির হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ডলারের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের। আর বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে ডলার দেওয়া হয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে। এ ক্ষেত্রে খাতের গুরুত্ব বুঝে ডলার ছাড় করা হয়। তবে দেশের প্রয়োজনে ডলার ছাড় করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো ধরনের গাফিলতি নেই।’ [ খবর : দেশ রূপান্তর অনলাইন]