মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে বিশেষ আনসার সদস্য হোসেন আলী হত্যাকারীদের কাছে পৌঁছে যায় ডিবি

0

 

মীর মঈন হোসেন মুসা ॥ তিন বছর আগে যশোর সদর উপজেলার হাশিমপুর বাজারে দিনদুপুরে বিশেষ আনসার সদস্য হোসেন আলী তরফদারকে গুলি চালিয়ে ও ছুরিকাঘাতে খুন করেছিলেন কথিত চরমপন্থিরা। হোসেন আলী তরফদারও এক সময় চরমপন্থি সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু হত্যাকারীদের প্রত্যক্ষদর্শীরা চিনতে পারলেও প্রাণের ভয়ে সেই সময় তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে মুখ খুলতে সাহসটুকু পাননি। তবে শেষ পর্যন্ত হত্যাকারীদের আটকে সক্ষম হয়েছিলো ডিবি পুলিশ। এমনকী হত্যাকাণ্ডে আলোচিত কথিত চরমপন্থি জুয়েলও ধরা পড়ে যায় ডিবি পুলিশের জালে। কীভাবে হোসেন আলী তরফদার হত্যাকা জড়িতরা ডিবি পুলিশের জালে ধরা পড়লো সেই সম্পর্কে সংস্থার এসআই মফিজুল ইসলাম বলেন, ২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর সদর উপজেলার হাশিমপুর বাজারে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন বিশেষ আনসার সদস্য হোসেন আলী তরফদারকে। এ খবর পেয়ে ডিবি পুলিশসহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে ছুটে যান। কিন্তু প্রকাশ্যে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় লোকজন খুনিদের চিনতে পারলেও ভয়ে মুখ খুলতে পারেননি। অবশ্য বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে পুলিশ হত্যার সাথে জড়িত কয়েকজনের নাম জানতে পারে। এর মধ্যে কিলার হিসেবে আলোচিত জুয়েলেরও নাম ছিলো। এরপর কোতয়ালি থানায় মামলা হলে ডিবি পুলিশ তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে বিশেষ করে মোবাইল ফোন নম্বর ট্র্যাকিং করে জুয়েল গংকে আটকের চেষ্টা করতে থাকে। ৫দিন পর মোবাইল ফোন নম্বর ট্র্যাকিং করে মাগুরায় শ্বশুরবাড়ি এলাকায় জুয়েল অবস্থান করছেন বলে শনাক্ত করা হয়। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর জুয়েল এবং বাবু নামে তার সঙ্গীর মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। এ কারণে তারা ডিবি পুলিশ জুয়েলের নাগাল পাননি। তখন মোবাইল ফোন নম্বর ট্র্যাকিং করে দেখা যায়, জুয়েলের সাথে মাগুরায় আসা আরো ৫ সঙ্গীর সর্বশেষ অবস্থান ঢাকার নীলক্ষেত এলাকায়। ফলে ডিবি পুলিশের সন্দেহ হয় যে, জুয়েলও পালিয়ে মাগুরা থেকে ঢাকায় চলে গেছেন। এরপর জুয়েলের আরেক সহযোগী রাসেলের মোবাইল ফোন নম্বর ট্র্যাকিং করে তার ঢাকার নীলক্ষেত এলাকায় তার অবস্থান শনাক্ত করা হয়। পরে ঢাকার নীলক্ষেত এলাকায় গিয়ে মোবাইল ফোন নম্বর ট্র্যাকিং ও বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে রাসেলকে একটি জুতার দোকান থেকে আটক করা হয়। মাগুরা থেকে পালিয়ে ঢাকায় গিয়ে ওই জুতার দোকানে চাকরি নিয়েছিলেন রাসেল। আটকের পর তাকে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করে তার মাধ্যমে নীলক্ষেতে থাকা আরো ৪ জনকে ডেকে আনা হয়। তারা আসার সাথে সাথেই ওৎ পেতে থাকে ডিবি পুলিশ সদস্যরা তাদেরকে আটক করেন। মাগুরা থেকে পালিয়ে ঢাকায় গিয়ে ওই ৪ জন নীলক্ষেতের একটি ফার্নিচারের দোকানে চাকরি নিয়েছেলেন। এরপর তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এবং তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে জুয়েল ও বাবুর খোঁজ পাওয়া যায়। যশোর সদর উপজেলার কুয়াদায় ফুফুবাড়িতে জুয়েল আত্মগোপন করে আছেন এবং তার সাথে বাবুও রয়েছেন তথ্যটি নিশ্চিত হওয়ার পর একদিন পর রাতের বেলায় সেখানে হানা দেয় ডিবি পুলিশ। কিন্তু ডিবি পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে কৌশলে তাদের জাল ভেদ করে সেখান থেকে পালিয়ে যান জুয়েল। তবে তারা সেখানে বাবুকে পেয়ে যান। আটকের পর বাবু তার সাথে জুয়েল ছিলেন বলে স্বীকার করেন। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মাগুরায় জুয়েলের শ্বশুরবাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে হোসেন আলী তরফদার হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি বার্মিজ চাকু উদ্ধার করেন। কিন্তু তারা যাকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন সেই জুয়েলের কোনোভাবেই সন্ধান পাচ্ছিলেন না। সুচতুর জুয়েল ঘনঘন মোবাইল ফোন নম্বর পরিবর্তন করায় তাকে কঠিন হয়ে পড়ে। তবে হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক মাস পর জুয়েলের নতুন একটি মোবাইল ফোন নম্বর ডিবি পুলিশ পেয়ে যায়। তার অবস্থান কক্সবাজারে। ফলে একজন কনস্টেবলকে সাথে নিয়ে কক্সবাজারে চলে যান এসআই মফিজুর রহমান। পরে তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, জুয়েল কক্সবাজারের হোটেল কক্সভিউ এর একটি রুমে কয়েকদিন ধরে অবস্থান। কক্সবাজারে যাওয়ার পরদিন সকালে ওই হোটলের নিচে বসে একই টেবিলে মুখোমুখি চেয়ারে বসে সাদা পোশাকে এসআই মফিজুল ইসলাম এবং তার সঙ্গী কনস্টেবল খাবার খাচ্ছিলেন। এ সময় হঠাৎ ওই কনস্টেবল খেয়াল করেন এসআই মফিজুল ইসলামের পেছনে জুয়েল দাঁড়িয়ে আছেন। ইতোপূর্বে জুয়েলের ছবি সংগ্রহ করে রাখায় জুয়েলকে চিনতে অসুবিধে হয়নি ডিবি পুলিশ কনস্টেবলের। সাথে সাথে কৌশলে ওই কনস্টেবল সেখানে জুয়েলের অবস্থান জানিয়ে দেন এসআই মফিজুল ইসলামকে। এরপর খাবার টেবিল থেকে উঠে কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই জুয়েলকে আটক করেন এসআই মফিজুল ইসলাম। পরে তাকে যশোরে নিয়ে আসা হয় এবং তার স্বীকারোক্তিতে হাশিমপুর এলাকায় অস্ত্র উদ্ধারে নিয়ে গেলে তার সহযোগীরা তাকে ছিনিয়ে নিতে ডিবি পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। ডিবি পুলিশও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান জুয়েল।
কী কারণে হোসেন আলী তরফদার প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছিলেন সেই সম্পর্কে এসআই মফিজুল ইসলাম বলেন, মূলত হোসেন আলী এক সময় নিষিদ্ধ সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি সরকারের সাধারণ ক্ষমার আহবানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের পর তাকে বিশেষ আনসার সদস্য পদে চাকরি দেয়া হয়। তবে তিনি চাকরি করলেও চরমপন্থির আদর্শকে চালন করতেন। তাছাড়া প্রতিপক্ষ চরমপন্থিদের সাথে তার নানা কারণে বিরোধ ছিলো। এর মধ্যে সন্ত্রাসী জুয়েলের সাথে এলাকা ভিত্তিক দ্বন্দ্ব এবং প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী মুন্নার পিতা আমিরুল ইসলাম বুলি ও জুয়েলের ভাই বাবলা খুন হওয়ায় এর পেছনে হোসেন আলী তরফদারের হাত ছিলো বলে সন্দেহ করা হতো। এসব নানা কারণে প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীরা তাকে খুন করেন বলে মামলার তদন্তে উঠে আসে। #