গোয়েন্দা কাহিনী-১৫ : মুঠোফোনের জাল চিহ্নিত করে দেয় মান্নাতের খুনিদের

0

মীর মঈন হোসেন মুসা ॥ দুই বছর আগে যশোর শহরের কারবালা এলাকায় রাস্তার পাশ থেকে হত্যার শিকার এস্কেভেটর শ্রমিক ইসরাফিল হোসেন মান্নাতের লাশ উদ্ধার করেছিলো পুলিশ। কিন্তু কে বা কারা কেন তাকে হত্যা করেছেন কেউ তা জানতেন না। তার লাশ উদ্ধারের ঘটনায় ওই সময় শহরে ব্যাপক তোলপাড় হয়। তবে হত্যাকাণ্ডটি ক্লু-লেস হওয়ায় রহস্য উদ্ঘাটন এবং খুনিদের শনাক্ত ও আটকে অভিযানে নামে ডিবি পুলিশ। শেষ পর্যন্ত ডিবি পুলিশ খুনের সাথে জড়িতদের শনাক্ত ও আটক করতে সক্ষম হয়। তাও আবার নিহতের ভগ্নিপতি শাহ আলমের প্রাইভেটকারচালক আল আমিনের মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে।
মান্নাত হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন এবং জড়িতদের কীভাবে শনাক্ত করা হয়েছিলো সেদিনের সেই অভিযান সম্পর্কে ডিবি পুলিশের এসআই মফিজুল ইসলাম বলেন, ২০২০ সালের ২৪ অক্টোবর ভোরে লোকজন কারবালায় রাস্তার পাশে অজ্ঞাতনামা একটি লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। তার মাথায় কোনোকিছু দিয়ে আঘাতের গুরুতর জখমের চিহ্ন ছিলো। তবে প্রথমে অজ্ঞাত হিসেবে উদ্ধার করা হলেও পরে পরিবারের লোকজন বিভিন্নভাবে খবর পেয়ে এসে লাশটি বকচর এলাকার মান্নাতের বলে শনাক্ত করেন। কিন্তু কেন কীজন্য কারা তাকে এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন তা পরিবারের লোকজন জানতেন না। স্থানীয় কেউ এ বিষয়ে বলতে পারেননি। এরপর কোতয়ালি থানায় মামলা হলে রহস্য উদ্ঘাটন এবং হত্যার সাথে জড়িতদের শনাক্ত ও আটকে অভিযানে নামে ডিবি পুলিশ। এক পর্যায়ে নিহত মান্নাতের মোবাইল ফোন নম্বরে কললিস্ট সংগ্রহ করে দেখা যায় যে, হত্যার আগেরদিন ২৩ অক্টোবর তিনি মোবাইল ফোনে আল-আমিন নামে এক ব্যক্তির সাথে বেশ কয়েকবার কথা বলেছেন। আবার আল-আমিন মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন শাহ আলম নামে আরেকজনের সাথে। অপরদিকে শাহ আলম মোবাইল ফোনে আরো কয়েকজনের সাথে কথা বলেছেন। পরে সকলের কললিস্ট পর্যালোচনা করে সন্দেহ হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে প্রথমে ৪ জনকে আটক করা হয়। এরা হচ্ছেন-সদর উপজেলার মাহিদিয়া গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে আল-আমিন ওরফে গ্যারেজ আল-আমিন, সুজলপুরের আব্দুর রশিদ শেখের ছেলে রায়হান শেখ, শফিকুল ইসলাম বাবুর ছেলে নয়ন হোসেন ও শহরের পুরাতন কসবা কাঁঠালতলা এলাকার আবু তাহেরের ছেলে রিফাত। এদের সাথে শাহ আলমের মোবাইল ফোনে কথা হয়েছিলো। আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে জানা যায়, মান্নাত মোবাইল ফোনে যে আল আমিনের সাথে কথা বলেছিলেন তিনি শহরের পুরাতন কসবা মানিকতলা এলাকার শাহ আলমের প্রাইভেটকারচালক। আবার শাহ আলম হলেন নিহত মান্নাতের ভগ্নিপতি। তাদের কাছ থেকে আরো তথ্য পাওয়া যায়, মান্নাতের স্ত্রী সুমির সাথে পরকীয়া ও অনৈতিক সম্পর্ক ছিলো ভগ্নিপতি শাহ আলমের। এরই জের ধরে শাহ আলমের পরিকল্পনায় মান্নাতকে খুন করেন আটকরা। কীভাবে খুন করা হয়েছিলো সেই সম্পর্কে ডিবি পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, ভগ্নিপতি শাহ আলমের সাথে পরকীয়া সম্পর্কের কারণে স্ত্রী সুমির সাথে মান্নাতের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কিন্তু সুমির সাথে ছাড়াছাড়ি হলেও মন্নাত জানতে পারেন, তার সাবেক স্ত্রীকে যশোরের কোথাও রেখে দিয়ে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন শাহ আলম। ফলে তিনি এ সংক্রান্ত খবর জানার জন্য শাহ আলমের গাড়িরচালক আল-আমিনের সাথে গোপনে যোগাযোগ করেন। কিন্তু আল-আমিন তার মালিক শাহ আলমের কাছে বিষয়টি ফাঁস করে দেন। এরপর শাহ আলম চালক আল-আমিনকে ব্যবহার করে মান্নাতকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী চালক আল-আমিন সাবেক স্ত্রী সুমির খোঁজ দেওয়ার কথা বলে ২০২০ সালের ২৩ অক্টোবর রাতে মোবাইল ফোন করে মান্নাতকে দড়াটানায় দেখা করতে বলেন। এ খবর পেয়ে গামছা দিয়ে মাথা ঢেকে বাইসাইকেলে করে দড়াটানায় আসেন মান্নাত। এরপর মান্নাত দড়াটানা থেকে আল-আমিনের গাড়ির পিছু পিছু সাইকেল চালিয়ে কারাবালা এলাকায় যান। পরে তাকে সেখানকার একটি গলিতে নিয়ে যান চালক আল-আমিন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আগে থেকে সেখানে ওৎ পেতেছিলেন শাহ আলমের ভাড়া করা গ্যারেজ আল-আমিন, রায়হান শেখ, নয়ন হোসেন ও রিফাত। এ সময় কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকে এসে আচমকা মান্নাতের মাথায় ইট দিয়ে জোরে আঘাত করেন একজন। সাথে সাথে গ্যারেজ আল-আমিন এমএস পাইপ দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর হত্যার সাথে জড়িতরা সেখান থেকে পালিয়ে যান।