অনেক করেছেন আর নয়, এবার পদত্যাগ করুন : মির্জা ফখরুল

0

 

মো. জামাল হোসেন, খুলনা॥ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, অনেক করেছেন, আর নয়। এবার পদত্যাগ করুন। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগের চিহ্ন থাকবে না। তাই আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে শেখ হাসিনার সরকার নতুন পাঁয়তারা শুরু করেছেন। সংসদ বিলুপ্ত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবানও জানান তিনি।
শনিবার খুলনা নগরীর ডাকবাংলো সোনালী ব্যাংক চত্বরে আয়োজিত বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি, নির্বাচনকালীন সরকার দাবি এবং জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, পুলিশের গুলিতে নেতাকর্মী নিহত, হামলা ও মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে গণসমাবেশের অংশ হিসেবে খুলনায় বিভাগীয় এ সমাবেশের আয়োজন করে বিএনপি।
মির্জা ফখরুল জনতার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখে বলেন, ২০১৮ সালে ভোট দিতে পেরেছিলেন? আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলে আওয়ামী লীগ। ফলে ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোন নির্বাচন হবে না। আর সে জন্য এই সরকারকে, শেখ হাসিনাকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে।
তিনি বলেন, রাম দা, পিস্তল ঠেকিয়ে শেখ হাসিনার সরকার জোর করে ক্ষামতায় থাকতে চায়। তারা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে জানগণকে বঞ্চিত করে বিনা ভোটে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। অথচ বিশ্ব জানতে পেরেছে- আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। বিচার বিভাগকে দলীয়করণ এবং প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের আখড়ায় পরিণত করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে  ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।


সরকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, অনেক ক্ষতি করেছেন, গত ১৫ বছরে আমাদের অর্থনীতি ধ্বংস করা হয়েছে। ভালো অর্জনগুলো ধ্বংস করে দিয়েছেন। মেগাপ্রকল্পের নামে মেগা লুট করেছেন। শেয়ার বাজার লুট করেছেন। ব্যাংকের টাকা  লুট করে বিদেশে পাচার করেছেন। বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছেন।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন নগর বিএনপির আহবায়ক এসএম শফিকুল আলম মনা। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ও অ্যাড. নিতাই রায় চৌধূরী।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরও বলেন, তিন দিন ধরে বাস-লঞ্চ বন্ধ, নৌ-খেয়াঘাট বন্ধ করে রাখা হয়েছে। তারপরও গণতন্ত্রের আকাংখা, অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম-লড়াই তা থেকে বাঁধা দিতে পারেনি। ইতিহাস বলে, জনগণের ন্যায়সংগত দাবি উপেক্ষা করে শক্তি দিয়ে বলপ্রয়োগ করে দমিয়ে রাখা যায় না। গত কয়েকদিনে ৫ শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার এবং হাজারও নেতা-কর্মীকে আহত করা হয়েছে। মোংলা, দিঘলিয়া, রূপসা, খালিশপুর, দৌলতপুর, খানজাহান আলী এবং বাগেরহাটসহ বিভিন্ন স্থানে দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা ও গুলি চালানো হয়েছে।
তিনি বলেন, আজ এ দেশকে শেখ হাসিনার অবৈধ সরকার নরকে পরিণত করেছে। মানুষ আজ ভোট, ভাত ও বাসস্থানের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে রাজপথে নেমেছি। বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশেই আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াই শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মুখে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনীর বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা ও লুটপাটের জন্য দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। আবারও ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী দুঃশাসনের কারণে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ ভেবেছিল খালেদা জিয়াকে জেলে দিলে বিএনপি শেষ হয়ে যাবে। তবে না, বিএনপি নতুন সাহসে বলীয়ান হয়ে উঠেছে। এই জনসমুদ্র তারই প্রমাণ। বীর খুলনাবাসী। আজকের এই সমাবেশ আমাদের ভবিষ্যতের স্বপ্নের নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দূর থেকে দেখছেন। আপনারা নানা বাঁধার পরও সমাবেশ সফল করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমার মা, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, দলের চেয়ারপারসন, যাকে অন্যায়ভাবে, বেআইনিভাবে, গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। সেই খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে এবং সেই নেতা যিনি আমাদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, সেই তারেক রহমানের পক্ষ থেকে আপনাদের অভিবাদন জানাচ্ছি।’
ফখরুল বলেন, ‘তিন দিন ধরে সব পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। বাস, লঞ্চ, খেয়াঘাট বন্ধ করেছে, তারপরও কি আপনাদের এই গণতন্ত্রের যে আকাঙ্খা, আপনাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম তাতে কি বাধা দিতে পেরেছে, পারে নাই। ইতিহাস বলে, জনগণের ন্যায়সংগত দাবি শুধু শক্তি দিয়ে দমিয়ে রাখা যায় না।’
ফখরুল বলেন, গত দুই তিন দিনে ৫ শতাধিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। হাজারো নেতাকর্মীকে আহত করেছে। চুকনগরে তিনজনকে গুলি করেছে, কেশবপুরে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ। মোংলায় ট্রলারে আসা কয়েকশ নেতাকর্মীকে আহত করেছে। ট্রলার ডুবিয়ে দিয়েছে। রূপসা, তেরখাদা, দিঘলিয়ার জনগণের একমাত্র বাহন ট্রলারে আসা ১০০ নেতাকর্মীকে আহত করেছে।
তিনি বলেন, ‘খালিশপুর, দৌলতপুর, খান জাহান আলী থেকে আসার সমবেশে আসা নেতাকর্মীদের আহত করা হয়েছে। বাগেরহাটে হামলা করে ৭০ জনের মত নেতাকর্মীকে আহত করেছে, গ্রেপ্তার করেছে ৫০ জন নেতাকর্মীকে। খুলনার ৫ ও ৭ নং ঘাটে আসা ট্রলার ডুবিয়ে দিয়েছে। গাজীরহাটের একজন কর্মীকে পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছে, এখনো তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।
‘খুলনা রেলস্টেশনে নেতাকর্মীদের মারধর করেছে। রামপাল, কাটাখালিতে হামলা হয়েছে, রূপসা ঘাটে হামলা হয়েছে, জেলখানা ঘাটেও হামলা হয়েছে। এত মানুষ আহত হলো, এত মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হল কেন? শুধু মিটিং বন্ধ করার জন্য?’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশে বলেন, যুদ্ধটা পুলিশের বিরুদ্ধে না। পুলিশ বাহিনীকে বুঝতে হবে। পুলিশ জনগণের টাকায় চলে জনগণের সেবা করার জন্যে। পুলিশ বাহিনী প্রধানমন্ত্রীর বাসার চাকর-বাকর না, যে যা বলবে তাই শুনতে হবে। ভয় পাবেন না, কোনো অন্যায় আদেশ পালন করবেন না সরকাররে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সমাবেশ বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়ক শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘অচিরেই আমরা ক্ষমতায় যাচ্ছি। আমরা আওয়ামী লীগকে কখনো ক্ষমা করব না। কয়েক দিনের মধ্যে তারা আমাদের পাঁচজনকে হত্যা করেছে। এই প্রতিশোধ নেব।’
তিনি আরও বলেন, ‘খুলনা থেকে শপথ, শেখ হাসিনার অধীনে আর কোনো নির্বাচন করতে দেব না। আওয়ামী লীগের লোকেরা বলেছিল পদ্মার এপারে কোনো সমাবেশ করতে দেবে না। তারা একটু এসে দেখুক, লজ্জা পাবে। এখানে জনসমুদ্র হয়েছে।’

বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন,সব কিছু বন্ধ করে দেওয়ার পরও খুলনা বিভাগের মানুষ পিঁপড়ার মত হেঁটে হেঁটে সমাবেশে উপস্থিত হয়েছে। সাতক্ষীরার সুন্দরবন তীরবর্তী শ্যামনগর থেকে আট ঘন্টা ট্রলারে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে এ জনসমুদ্রে উপস্থিত হয়েছে। মেহেরপুরের ভাইয়েরা প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার দূর থেকে কখনও গাড়িতে-কখনও ট্রেনে-কখনও মোটরসাইকেলে এসে আজকের আয়োজন সফল করেছে। মাগুরা থেকে যে সমস্ত নেতা-কর্মীরা উপস্থিত হয়েছেন তারা আওয়ামী লীগের হামলার শিকার হয়েছেন। একশ’ নেতা-কর্মী খুলনায় গ্রেফতার হয়েছেন। আমার নিজের জেলা যশোর থেকে নেতা-কর্মীরা আসার পথে বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে। যশোর থেকে ৪৮জন এবং খুলনা থেকে ১৩জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার কেশবপুর থেকে আসা ১৩জন নেতা-কর্মীকে সোনাডাঙ্গা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আজকে আইন-শৃংখলা বাহিনী ভেবেছিল আমরা দুর্বল। খুলনা রেল স্টেশনে আমাদেরকে আঘাত করতে চেয়েছিল। কিন্তু যশোরের মানুষ যথাযথ উত্তর দিয়েছে। খুলনা বিভাগের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতা-কর্মীরা রাজপথের তপ্ত রোদে আগের দিন রাত থেকে নির্ঘুম কাটিয়েছে।
‘আমাদের খুলনায় গণসমাবেশে জনসমুদ্র আর এই বিশাল আয়োজন দেখে বিস্মিত হয়েছেন আমাদের প্রিয় নেতা তারেক রহমান। তিনি দলের মহাসচিবকে এ কথা জানিয়েছেন।’ তিনি শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ভেবেছিল তাদের বাধায় আমাদের কেউ আসবে না। তবে এখানে জমায়েত জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। তাদের দেখিয়ে দিয়েছি, আমাদের দুর্বল ভেব না।
তিনি শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছেন। আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর যে আঘাত হেনেছেন, প্রতিটি রক্তের, প্রতিটি ঘামের রাজনৈতিক প্রতিশোধ নেব ইনশাআল্লাহ।
অনিন্দ্য ইসলাম অমিত আরও বলেন, যেভাবে আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি, সেভাবে হেঁটে হেঁটে গণভবনে পৌঁছে যাব ইনশাআল্লাহ। সেখানে হাসিনাকে ওই মসনদ থেকে টেনে-হেঁচড়ে নামিয়ে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের দাবি প্রতিষ্ঠা করেই ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।