হত্যা না আত্মহত্যা

0

 

জামাল হোসেন,খুলনা॥ জিএম ইমদাদুল ইসলাম মেহেদী। বয়স ৪২। একজন ব্যবসায়ী। খুলনা মহানগরীর হকার্স মার্কেটে ‘মেহেদী ক্লথ স্টোর’ নামে শাড়ি কাপড়ের একটি দোকানের মালিক তিনি। গত ১১ আগস্ট খুলনা মহানগরীর জোড়াগেট রেল ক্রসিং সংলগ্ন রেল লাইনে তার লাশ পাওয়া যায়।
এদিকে ব্যবসায়ী মেহেদী ঋণের বোঝা সইতে না পেরে রেল লাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন- বলে প্রাথমিকভাবে প্রচার পায়। তবে বিষয়টি মানতে নারাজ তার পরিবারের সদস্যরা। কী পরিমাণ ঋণগ্রস্ত ছিলেন তিনি বা কারা তার কাছে টাকা পাবে, মৃতদেহের পাশ থেকে উদ্ধারকৃত চিরকুটের তথ্য এবং স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকাশ্য দিনের বেলায় এভাবে একজন সুস্থ মানুষ রেললাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবে- বিষয়টি অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ফলে তাকে কি হত্যা করা হয়েছে- নাকি তিনি আত্মহত্যা করেছেন- এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
মেহেদীর মৃতদেহের পাশ থেকে উদ্ধার হওয়া চিরকুট নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তিনি লিখিত চিরকুটে হকার্স মার্কেটের দুজন ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করে মূলত তার মৃত্যুর জন্য তাদেরকেই দায়ী করেছেন। এরা হচ্ছেন জনৈক সেবা ও মাসুম। তবে ঘটনার ৬ দিন পর পুলিশ এখনো পর্যন্ত এসব বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রম শুরুই করতে পারেনি।
নিহত ইমদাদুল ইসলাম মেহেদীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি খুলনা মহানগরীর বানরগাতী এলাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ রোড বাইলেন এলাকার মৃত নজরুল ইসলাম গোলদারের ছেলে। নাবিয়া সামিন মানহা (৭) এবং সিদরাতুল মুনতাহা (সাড়ে তিন বছর) নামে দু’টি কন্যা সন্তানের জনক তিনি।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনে কর্মরত তার বড় ভাই ইমরুল ইসলাম মুকুল এ প্রতিবেদককে বলেন, তাদের মধ্যে পারিবারিক কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। তারা তিন ভাই-বোন খুবই আন্তরিকভাবে বসবাস করতেন। এমনকি স্ত্রীর সঙ্গেও তার ছিল না কোন দ্বন্দ্ব বা পারিবারিক বিরোধ। ব্যবসায়িকভাবে বা অন্য কোন কারণে তার সঙ্গে কারোর দ্বন্দ্ব বা বিরোধ ছিল কিনা সেটিও তাদের জানা নেই। তবে কী কারণে রেল লাইনে ঝাঁপ দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করবেন- এটি তাদের কাছে পরিষ্কার নয়।
তিনি জানান, গত ১১ আগস্ট তার ছোট ভাই মেহেদী বেলা ১২টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে পাশের সিদ্দিকীয়া মাদ্রাসা থেকে তার বড় মেয়ে মানহাকে বাসায় দিয়ে দোকানে যান। সেখান থেকে যোহরের নামাজ আদায় করে একটি ছাতা নিয়ে বের হন। এরপর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে তার ভগ্নিপতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নূরুজ্জামানের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন তার ছোট ভাই মেহেদী দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এ খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে গিয়ে তার ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারেন নি।
তিনি বলেন, মেহেদী এর আগে হকার্স মার্কেটের দোকানে কর্মচারী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নিজেই একটি দোকান কিনে নেন। তবে সেখানে কী পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা অথবা তিনি কোন ঋণগ্রস্থ ছিলেন কিনা এ বিষয়ে তাদেরকে কখনোই কিছু জানান নি। এমনকি তার আচার-আচরণ বা কথাবার্তার মধ্যেও এ ধরনের কোন দুশ্চিন্তা বা হতাশাও তারা দেখেন নি। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন- আচরণ ছিল তার।
ব্যবসায়ী মেহেদীর আত্মীয় (স্ত্রীর বড় ভাই) কারিমুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না বলে তার বোনের (স্ত্রীর) কাছে হতাশা প্রকাশ করতেন মেহেদী। তবে কোন লেনদেন বা এজন্য কারো সাথে বিরোধ নিয়ে কোন কথা শোনেন নি তারা।
এদিকে নিহত ব্যবসায়ী মেহেদীর মামা নাজমুল হক বলেন, মেহেদীর মৃতদেহের পাশ থেকে যে চিরকুটটি উদ্ধার করা হয়েছে- তাতে হকার্স মার্কেটের দু’জন ব্যবসায়ী সেবা ও মাসুমের নাম লেখা ছিল। তাতে উল্লেখ করা ছিল- সেবার কারণে তিনি মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছেন। এমনকি তার কারণে মার্কেটের আরো অনেক ব্যবসায়ী মারা যাবে বলেও তাতে উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও আরো কিছু বিষয় উল্লেখ ছিল যা তিনি তাৎক্ষণিক খেয়াল করতে পারেন নি। চিরকুটটি আলামত হিসেবে রেলওয়ে পুলিশের হেফাজতে রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, মেহেদীর মৃত্যুর পর কোন ব্যবসায়ী বা কোন ব্যক্তি পরিবারের কাছে অর্থ পাবেন বলে দাবি করেন নি। ফলে তিনি যে ঋণগ্রস্ত ছিলেন সেটি স্পষ্ট নয়। তাহলে প্রকাশ্য দিনের বেলা তিনি কেন রেল লাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবেন সেটি কোন স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না। এর পেছনে অন্য কোন কারণ থাকতে পারে বলে তিনি ধারণা করছেন। তবে রেল পুলিশের তদন্তের অপেক্ষা করলেও তাকে হত্যা করা হতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি। এ বিষয় নিয়ে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়েও চিন্তাভাবনা করছেন বলেও জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে অপমৃত্যু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খুলনা রেলওয়ে জিআরপি থানার এসআই মো. ইদ্রিস বলেন, ব্যবসায়ী মেহেদী নিহতের ঘটনায় রেলের কর্তব্যরত মাস্টার বাদি হয়ে জিআরপি থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করেন। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, মেহেদীর মৃতদেহের পাশ থেকে যে চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছে- তাতে তিনি সুদে টাকা নিয়ে ঋণগ্রস্ত ছিলেন এবং এই পাওনাদারদের চাপেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে উল্লেখ রয়েছে। এ কারণেই প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তবে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হলে প্রকৃত তথ্য বের হবে বলে তিনি আশা করছেন।