দক্ষিণের ৬ জেলায় আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা

0

 

আকরামুজ্জামান ॥ আমন আবাদ গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে যশোরসহ দক্ষিণের ৬ জেলার চাষিদের। একদিকে প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাবে বৃষ্টিনির্ভর চাষ সেচনির্ভর হয়ে পড়া। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধিসহ সার-কীটনাশক, শ্রম খরচ মেটাতে গিয়ে শেষ সময়ে এসে কৃষক চরমভাবে হিমশিম খাচ্ছে। সব মিলিয়ে দিশেহারা প্রায় ৪০ শতাংশ চাষিই আমন চাষ করবেন কিনা সে বিষয়ে চরম অনিশ্চয়তায় রয়েছেন তারা। ফলে চলতি মৌসুমে যশোরাঞ্চলে আমনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের যশোর অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার জন্যে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৪ হেক্টর জমি। এরমধ্যে যশোর জেলায় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯৪৭ হেক্টর, ঝিনাইদহে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ হেক্টর, মাগুরায় ৬১ হাজার ৪৭২ হেক্টর, কুষ্টিয়ায় ৮৮ হাজার ৮৯৫ হেক্টর, চুয়াডাঙ্গায় ৩৪ হাজার ৯২০ হেক্টর ও মেহেরপুর জেলায় ২৬ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমি রয়েছে। এসব জমিতে হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাতের ধান চাষ করার কথা রয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত এ অঞ্চলে ৫০ শতাংশ জমিতেও আমন চারা রোপণ করা হয়নি।
এই ৬ জেলার মধ্যে শুধুমাত্র যশোর, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলায় পর্যন্ত ৬০ শতাংশ জমিতে আমনের চারা রোপণ করা হয়েছে। বাকি কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলায় সবেমাত্র বৃষ্টি পেয়ে আমন চাষ শুরু হলেও এখনও পর্যন্ত অনেক চাষি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
চাষিরা জানান, আমন ধান মূলত বৃষ্টি নির্ভর একটি চাষ। সাধারণত বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টির পানিতে সাশ্রয়ী খরচে আমন আবাদে ঝুঁকে পড়েন চাষিরা। তবে এ বছর বর্ষা মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় চাষিরা আমন চাষে অনেকটা পিছিয়ে পড়েন। কিছু এলাকার চাষিরা ডিজেল ও বিদ্যুৎ চালিত সেচ পাম্পের মাধ্যমে চাষ শুরু করলেও অধিকাংশ চাষিরাই বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। সবশেষে শ্রাবণের মাঝামাঝি সময়ে বৃষ্টির দেখা দিলেও পর্যাপ্ত ছির না। এদিকে ডিজেল, কেরোসিনের অস্বাভাবিক দামের কারণে বিপত্তিতে পড়েছেন কৃষকরা।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানাগেছে, জেলায় ডিজেল চালিত অগভীর নলকূপ রয়েছে প্রায় ৬২ হাজার। আর গভীর নলকূপ রয়েছে ১১৭ টি। এর বাইরে পাওয়ার টিলার রয়েছে প্রায় ৯ হাজার। আমন আবাদে এসব ডিজেল চালিত সেচ পাম্প ও পাওয়ার ট্রিলার সরাসরি ব্যবহার হচ্ছে। ফলে বর্তমান তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে তাদের খরচ বেড়ে গেছে প্রায় দ্বিগুণ।
মাঠে মাঠে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে অন্যবছর এসময় পুরোদমে ধান রোপণ শুরু হলেও এবার বৃষ্টির অভাবে বেশিরভাগ জমিতেই চাষ শুরু হয়েছে দেরিতে। কাঙ্খিত বৃষ্টি না হওয়ায় অধিকাংশ জমিতেই সেচ দিয়ে আমন চাষ করতে হচ্ছে চাষিদের। এতে খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন চাষিরা।
মণিরামপুর উপজেলার ভান্ডারিয়া মোড়ে কথা হয় কৃষক আব্দুর রশিদের সাথে। তিনি বলেন, আমন চাষ নিয়ে তারা চরম সমস্যায় রয়েছেন। কদিন আগেই বেড়েছে ইউরিয়া সারের দাম। এরপর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে সব ধরণের কৃষি পণ্যের দামও ইতিমধ্যে বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় কৃষি শ্রমিকরাও তাদের মজুরি বাড়িয়ে দিয়েছেন। সব মিলিয়ে আমরা কুলিয়ে উঠতে পারছিনা। তিনি বলেন, আমি ৫ বিঘা জমিতে আমন আবাদের পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছিলাম। ইতিমধ্যে দুই বিঘায় ধান রোপণ করা হয়েছে। বাকি তিন বিঘা নিয়ে কী করবেন ভেবে উঠতে পারছেন না।
একই কথা বলেন খুরশেদ আলম নামে আরেক চাষি। তিনি বলেন, আগে প্রতি বিঘা জমিতে সেচ দিতে ৪ লিটার মতো ডিজেল লাগতো। এখন তার চেয়ে বেশি লাগছে। দিনের অধিকাংশ সময় বিদ্যুৎ থাকেনা। এ কারণে কমপক্ষে ১০ বার সেচ দেওয়া লাগে। সে হিসেবে প্রতি বিঘায় প্রায় ৪০ লিটার ডিজেল লাগে সেচ দিতে। এ অবস্থায় বাড়তি দামে ডিজেল কিনে সেচ দিতে আগের চেয়ে খরচ ১ হাজার ৩৬০ টাকা বেশি লাগছে। তিনি বলেন, ডিজেলের দাম যেমন বেড়েছে ঠিক তেমনি সেচ খরচও বেড়েছে। এ অবস্থায় আমন আবাদে লাভ কীভাবে হবে সেই চিন্তায় রয়েছেন।
জেলার অন্যান্য এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে সম্প্রতি বৃষ্টি হওয়ার পর কৃষক আমন আবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তবে অনেক চাষিই খরচের ভয়ে আমন আবাদে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এতে আমন আবাদের লক্ষমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ।
এব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোরের উপ-পরিচালক মঞ্জুরুল হক বলেন, জ্বালানি তেলের প্রভাব শুধু কৃষির ওপর পড়েনি, সব ক্ষেত্রেই পড়েছে। এটি শুধু আমাদের দেশের সমস্যা নয়। তারপরও আমাদের কৃষি অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা নিয়েছে। তিনি বলেন, আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আপাতত নেই। কারণ ইতিমধ্যে এ অঞ্চলে বৃষ্টি হচ্ছে। কৃষক এই বৃষ্টিতেই আমন চাষ করতে পারবেন। বেশি খরচে চাষ করলেও ধানের কাঙ্খিত দাম পেলে কৃষক উৎপাদন খরচ মিটিয়ে লাভবান হবেন বলে তিনি আশাবাদ করেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মো. এখলাছ হোসেন বলেন, বৃষ্টির কারণে আমন আবাদ কিছুটা পেছালেও এখন বৃষ্টি শুরু হওয়ায় চাষ পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে যশোরাঞ্চলের ৬ জেলার আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরিই সফল হবে বলে তিনি অঅশাবাদ ব্যক্ত করেন।