ডুবছে হাওর, কাঁদছে কৃষক

0

বিশেষ সংবাদদাতা॥ সীমান্তের ওপার ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের সুনামগঞ্জের সুরমা, যাদুকাটা, কুশিয়ারাসহ সকল নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ঝুঁকিতে পড়েছে অনেক হাওরের বাঁধ। অতিরিক্ত পানির চাপে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বহু বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। বাঁধ ভেঙে একের পর এক হাওর ডুবছে। স্বেচ্ছাশ্রম দিনরাত বাঁধ মেরামতে কাজ করছেন হাওরপাড়ের কৃষকরা। সময় মতো বাঁধের কাজ শেষ না করা পানির চাপে দুর্বল বাঁধে ফাটল দেখা দেয়ায় ফসলের সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বোরো চাষীদের মাঝে। জীবন জীবিকার সন্ধিক্ষণে বাঁধ রক্ষায় প্রানপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন হাওর পাড়ের কৃষকরা। বাঁধ মেরামতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজনের পাশাপাশি সর্বসাধারণকে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
রিপোর্ট লেখার আগ পর্যন্ত মঙ্গলবার দুপুর ২টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি ৫.৯৯ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছে। বিপদসীমার কাছা কাছি অবস্থায় থাকা এই পানি আরও বৃদ্ধি পেলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে বলে আগামী ২৪ ঘন্টা সময়কে সুনামগঞ্জের জন্য বিপজ্জনক সময় উল্লেখ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। জানা যায়, শনিবার সকালে নজরখালি বাঁধ ভেঙে টাঙ্গুয়ার হাওরে ঢুকতে শুরু করে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি। পানির নিচে তলিয়ে গেছে প্রায় ৩০০০ হাজার একর জমির ফসল। সোমবার বিকালে শাল্লা উপজেলার দাঁড়াইন নদীর পানি উপছে বাঘার হাওরে প্রায় ৫০০ একর জমির ফসল তলিয়ে যায়। পানি উপছে তলিয়ে গেছে দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের একটি হাওর, সদর উপজেলার ছোট কাংলার হাওরসহ ছাতক উপজেলার কয়েকটি ছোট ছোট হাওরের ফসল পাহারি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে।
এদিকে, ঢলের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পানির চাপে জেলার শান্তিগঞ্জ, দিরাই, ধর্মপাশা, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার অনেকগুলো বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের পাউবোর তুফানখালি বাঁধ, ফাটল দেখা দেওয়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে বরাম হাওরের বোরো ফসল। তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওরের আনন্দনগর বাঁধ দেবে গেছে। এই বাঁধ নতুন করে সংস্কার করছেন পিআইসির লোকজন। শান্তিগঞ্জ উপজেলার শালদিকা, রাঙ্গামাটি, বেদাখালিসহ একাধিক বাঁধে ফাটল দেখা দেয়ায় সোমবার রাতে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ মেরামতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন সংশ্লিষ্ট গ্রামের চাষীরা। বিশ্বমম্ভরপুর উপজেলার হরিমন ভাঙ্গা ফাটল দেখা দেয়ায় ঝুঁকিতে রয়েছে করচার হাওরের প্রায় ৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল। এছাড়াও জামালগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা ও জগন্নাথপুর উপজেলার অনেক বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। এসব বাঁধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সাথে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন স্থানীয়রা। সংশ্লিষ্ট উপজেলার মসজিদের মাইকে মাইকিং করে বাঁধ মানুষকে আহবান করা হচ্ছে। জীবন জীবিকার একমাত্র ফসল ঘরে তুলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় সময় পার করছেন হাওর পাড়ের কৃষককুল। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরের পাড়ের কৃষক রয়েল আহমদ বলেন, গত ৩দিন ধরে বাঁধে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করছি। স্থানীয় কৃষকরা বাঁধ পাহাড়া দিচ্ছেন। বাঁধ রক্ষায় দিনরাত কাজ করছেন। যেকোনো সময় ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে। তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওর পাড়ের কৃষক ময়না মিয়া বলেন, সময় মতো বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় আজ এই অবস্থা। বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ডুবলে আমরা যাবো কোথায়। ছেলে-মেয়ে নিয়ে কি করে বাঁচবো। হাওরের ফসল হানি হলে আমাদের কে দেখবে। তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু বাবুল বলেন, নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শুরু ও শেষ না হওয়ায় আজ হাওরের এমন দশা। অনিয়ম দুর্নীতির মানুষের ফসল ঝুঁকিতে রয়েছে। যে ভাবে নদীর পানি বাড়ছে এটি অব্যাহত থাকলে হাওর এলাকায় মানবিক বিপর্জয় দেখা দিবে।
আগামী ২৪ ঘণ্টাকে সুনামগঞ্জের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ সময় বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহীদুল ইসলাম বলেন, পানি বাড়লে পরিস্থিতি কঠিন দিকে যাবে। স্থানীয়ভাবে মসজিদের মাইকে মাইকিং করা হচ্ছে। বাঁধে বস্তা বাঁশ রাখা হয়েছে। বাঁধ রক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন স্থানীয়রা। এদিকে সুনামগঞ্জর ধর্মপাশা উপজেলার কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ পরিদর্শন করে ড. মুহাম্মদ মোশারফ হোসেন জানান, ফসল রক্ষায় স্থানীয় কৃষকদের সাথে নিয়ে বাঁধে প্রশাসন কাজ করছে। ইতোমধ্যে ৫০০ হেক্টর জমি নিমজ্জিত হয়েছে। যদি পানি ধীরে ধীরে নেমে যায় তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমবে। আর যদি পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে তাহলে আমরা বিপদে পড়ে যাবো।