বিশ্ববিদ্যালয় হোক র‌্যাগিং মুক্ত

0

জান্নাতুল যূথী॥ শিক্ষার্থী মাত্রই উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু সেই উচ্চশিক্ষার পথ যদি হয় কণ্টকাকীর্ণ, তাহলে তার জান্য ভীতি ছাড়া কিছুই থাকে না। বর্তমানে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি ‘আচরণের’ সঙ্গে পরিচয় ঘটেনি, এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম! সেটি হলো ‘ র‌্যাগিং’ অর্থাৎ ‘ছিন্নবস্ত্রকরণ’। আভিধানিক অর্থে র‌্যাগিং হলো পরিচয়পর্ব, তিরস্কার করা, রসিকার নামে অত্যাচার, বর্বর আচরণ করা। র‌্যাগিংয়ে ধরন বিভিন্ন রকম হতে পারে। সাধারণত মনে করা হয়, র‌্যাগিং ইতিবাচক-নেতিবাচক দুভাবেই হতে পারে। তবে, এর ধরনগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলেই বোঝা যাবে, র‌্যাগিং আসলেই কী। এই বিষয়ে প্রথমে চোখে পড়ে, পরিচিত হওয়া, কবিতা আবৃত্তি, ঠা-ঠা রোদের ভেতর ক্যাম্পাসে দৌড়ানো, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন, সিনিয়রদের প্রপোজ করাসহ বিভিন্ন শারীরিক-মানসিক নির্যাতন। ইতোমধ্যে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাগিং বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। বিষয়টি যেন শুধু ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। যেন এর যথাযথ প্রয়োগ হয়। আশা করবো, এই শিক্ষাঙ্গনকে অনুসরণ করে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও এই ঘৃণ্য, ভয়াল অপসংস্কৃতি চিরতরে বিলুপ্ত হবে। র‌্যাগিংয়ের কথা উঠলে মহাভারতের দূতসভার কথাই মাথায় আসে। পাশা খেলায় ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির যখন হেরে যান, তখন দ্রৌপদীকেও সভায় হেনস্তা করার নির্দেশ দেয় প্রথম কৌরব দুর্যোধন। তবে, দুর্যোধনের যতটা না আক্রোশ দ্রৌপদীর ওপর, তারচেয়েও প্রবল হয়ে ওঠে দ্বিতীয় কৌরব দুঃশাসনের ক্রোধ। প্রবল ক্রোধ নিয়ে সে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে উদ্যত হয়। তখন স্বয়ং কৃষ্ণ রক্ষক হয়ে দৈববলে দ্রৌপদীর সম্ভ্রম রক্ষা করেন। মহাভারতের যুগ অস্ত গেছে। কিন্তু রয়ে গেছে দুর্যোধন-দুঃশাসনের ভূত। সেই প্রেতাত্মারা প্রাসাদ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ছেড়ে এখন শিক্ষাঙ্গনে ঢুকে পড়েছে। দুঃশাসনের হাতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ যেন সভ্য দুনিয়ার শিক্ষাঙ্গনের র‌্যাগিং (ছিন্নবস্ত্র) বলেও অত্যুক্তি হবে না। অর্থাৎ মহাভারতে যা ছিল দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, তাই আধুনিক কালে বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগত শিক্ষার্থীদের র‌্যাগিং বা ছিন্নবস্ত্রকরণ। বীভৎসতার নবরূপায়ণ! এ ছাড়া, আবাসিক হলে উঠলে তো এর প্রকার আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে! র‌্যাগিং একক বা যৌথ; দুভাবেই হতে পারে। এই র‌্যাগিংয়ের কথা শুনলে শিক্ষার্থীরা শিউরে ওঠেন! এরপরও কেন র‌্যাগিং? নিছক আনন্দ, নাকি এটি কোন বিশেষ উদ্দেশ্য বহন করে? ভালো বা মন্দ যে কাজই হোক তার পেছনে কিছু যুক্তিতর্ক থাকে। এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। মূলত সিনিয়ররা বিশ্বাস করেন, জুনিয়রদের সঙ্গে ভালো বোঝাপড়ার জন্য র‌্যাগিং উত্তম মাধ্যম। আরও বেশি বিশ্বাস করেন, ‘আচরণ শেখার অনুষ্ঠান’। কিন্তু এসব যুক্তি মানবিক মূল্যবোধের কাছে ধোপে টেকে না!
শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় মাতৃগর্ভ শিক্ষাঙ্গন। পরিপূর্ণ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের যোগ্য-দক্ষ করে তোলাও সমাজের দায়িত্ব। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন। তাই তাদের আচার-আচরণও ভিন্ন-ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। একজন শিক্ষার্থী যখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার উদ্দেশ্য আসেন, তখন প্রথম পর্যায়ে তার মধ্যে জড়তা থাকে। একইসঙ্গে থাকে নতুনত্বকে গ্রহণ করার সক্ষমতা নিয়ে দ্বিধাও। এ পর্যায়ে যদি যুক্ত হয় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, তবে শিক্ষার্থীর যে ভয়াবহ অবস্থা হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না। প্রথম দর্শনেই তার মনের গহীনে সংকোচ বাসা বাঁধে। ভয় থেকেই স্বাভাবিক গতি রহিত হয়। এরই বিরূপ প্রভাব পড়ে পড়াশোনায়। এসব অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়বিমুখ করে তোলে। এমনকি ভর্তি বাতিল করে অন্য অপশনকে বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকলে সেটা গ্রহণেও দ্বিধা করে না! র‌্যাগিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে হীনম্মন্যতায় ভোগে! কিন্তু র্যাগিংয়ের মাধ্যমে যেসব স্ল্যাং ব্যবহার করা হয়, সেগুলো। একজন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেই এ ধরনের স্ল্যাং শুনে ও মেন্টাল টর্চারের মুখোমুখি হওয়ায় তার কাছে অনেক সময় জীবন অসহনীয় হয়ে ওঠে। তাই তারা যে উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ক্যাম্পাস জীবনে প্রবেশ করেন, সেখানে তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। এর ফলে তাদের মধ্যে পড়াশোনায় অনীহা জাগে। এমনকি তারা আত্মহননের দিকেও পা বাড়ায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের মাঝে দুটি ধরন লক্ষণীয়। ইনট্রোভার্ট ও এক্সট্রোভার্ট। এরমধ্যে এক্সট্রোভার্টরা অনেক ক্ষেত্রে এগুলোকে হজম করে নেয়। কিন্তু যে ব্যক্তি আপন জগতে ঘূর্ণায়মান, তার মনের ওপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়ে। আচরণ সহ্য করতে না পেরে তারা হল থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসে সব সময় জড়সড়ো হয়ে থাকেন। মানসিকভাবে হীনম্মন্যতায় ভোগে। খুব অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীই ভয়কে জয় করে নিতে সক্ষম হন। যখন কোনো শিক্ষার্থী এই সক্ষমতা অর্জন করেন, তখন এই তিনি নিজের ওপর বহে যাওয়া ঝড়কে প্রবাহিত করে অনুজদের ওপর। এর মাধ্যমে তিনি একধরনের পৈশাচিক আনন্দ গ্রহণ করেন! এসব আনন্দ-নির্যাতনকে ভালো-মন্দের পাল্লায় যদি মাপা হয়, তাহলে বিবেকবান মানুষ একবাক্যে এই ধরনের বর্বরতার বিপক্ষেই অবস্থান নেবেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে র্যাগিং মারাত্মক প্রভাবে ফেলে। ব্যক্তির জীবনে যেমন এর প্রভাব পড়ে, ঠিক তেমনি সামাজিকভাবেও অস্থিরতা তৈরি করে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনকে রূঢ় করে তোলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনকে মনে রাখতে হবে, র‌্যাগিং কখনোই সুফল বয়ে আনে না। তাই এই ‘বর্বরতা’কে সমূলে উৎপাটন করে শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানবিক করে গড়ে তোলার পাশাপাশি ভালো-মন্দের বিভেদকে যেন শিক্ষার্থীরা চিহ্নিত করতে পারেন, সেই সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। আগেই বলেছি, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণেরই নবরূপ আজকের র‌্যাগিং। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা র‌্যাগিংয়ে শিকার হয়ে বিশ্ববিদ্যার সম্ভ্রম হারাতে বসেছেন! এখনই সময় দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে হতে হবে কৃষ্ণের মতো দ্রৌপদীর দীনবন্ধ। দুর্যোধন-দুঃশাসনদের হাত থেকে দ্রৌপদী নব সংস্করণ শিক্ষার্থীর রক্ষা করার উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই বাঁচবে শিক্ষার্থী, বাঁচবে জাতি। না হলে অচিরেই মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থী ছেড়ে দেবে বিশ্ববিদ্যালয়, কেউ কেউ করতে পারে আত্মহননও। তবে, এ কথাও সত্য, যে কোনো বিষয় একদিনেই ঠিক করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু চর্চা চালিয়ে গেলে একদিন সফলতা আসবেই। এ জন্য শুরু করাটাই জরুরি। ইতোমধ্যে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাগিং বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। বিষয়টি যেন শুধু ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। যেন এর যথাযথ প্রয়োগ হয়। আশা করবো, এই শিক্ষাঙ্গনকে অনুসরণ করে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও এই ঘৃণ্য, ভয়াল অপসংস্কৃতি চিরতরে বিলুপ্ত হবে।
লেখক: গবেষক, শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়।