কী ঘটছে ইমরানের ভাগ্যে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ক্লাইমেক্স! নাটকীয়তা। আকস্মিকভাবে পট পরিবর্তন পাকিস্তানে। হঠাৎ করেই রাজনীতিতে ঝড়। সেই ঝড়ে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান টিকে থাকতে পারবেন কিনা তা নিয়ে বোদ্ধাদের চুলচেরা বিশ্লেষণ। এতদিন বিরোধী দলগুলো তার সমালোচনা করছিল। পদত্যাগ দাবি করছিল। আর এখন তার নিজের ঘরেই আগুন লেগেছে। নিজের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ-এ এই (পিটিআই) বিদ্রোহ। পিটিআই’র বেশ কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। বিরোধীরা ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন জাতীয় পরিষদে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন বিদ্রোহী ওইসব সদস্য। শুক্রবার জাতীয় পরিষদে উঠছে এই প্রস্তাব। এ নিয়ে সাতদিন শুনানি হতে পারে। তারপর ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ভোট হতে পারে। আলোচনা আছে, সেনাবাহিনীর কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান খান। সম্প্রতি তাদের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে সেটা সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র প্রধান পদে নিয়োগ নিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন ইমরান। দৃশ্যত তিনি মসৃণভাবেই তার দেশ চালাচ্ছিলেন। তার সময়ে পাকিস্তানে আগের মতো বোমা হামলা, ভয়াবহতার খবর কমই পাওয়া গেছে। কিন্তু আকস্মিক রাজনীতিতে কি এমন ঘটলো যে ক্ষমতার শেষ বছরে এসে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব! ২০১৮ সালে তিনি ক্ষমতায় আসার পর এটাকে দেখা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে। যে যত যা-ই বলুন, যদি পাকিস্তানের শক্তিধর সেনাবাহিনীর আশীর্বাদের অদৃশ্য হাত কারো মাথার ওপর না থাকে, তাহলে তার ক্ষমতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। চারদিকে আলোচনা তেমনই কী কিছু হতে যাচ্ছে! জবাবে ইমরান খান বলেছেন, তিনি পদত্যাগ করবেন না। লড়াই করে যাবেন। কিন্তু সেই লড়াইয়ের ফল কি কেউ জানেন না। তবে বিচার বিশ্লেষণ যা বলছে, তাতে তার টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি ক্রিকেটের কিংবদন্তী। পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের চ্যাম্পিয়ন করেছেন। ট্রফি তুলেছেন ঘরে। সেই ক্রিকেটে যেমন শেষ বল পর্যন্ত কিছু বলা যায় না, তেমনি তার রাজনৈতিক পরিণতিও যেন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না কোনদিকে যায়।
পাকিস্তানকে আর্থিক সংকট থেকে উদ্ধার পর্বে পরবর্তী দফায় আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফ যখন ৬০০ কোটি ডলার দিতে চেয়েছে এবং তা নিয়ে রিভিউ করা হচ্ছে, তখন দেশটি এই অনাস্থা ভোটের ফলে সাংবিধানিক, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক সংকটকে আরও ঝুঁকিতে ফেলেছে। আইএমএফ’র রিভিউ হওয়ার কথা ছিল এই সপ্তাহে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তা হয়নি। এ মাসের শুরুর দিকে বিরোধী দলগুলো ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে জাতীয় পরিষদে। নিজের দলের প্রায় ২০ জন এমপি দলত্যাগ করায় তাতে বলা হয়, তিনি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন। ফলে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। এর জবাবে বুধবার রাতে ইমরান খানের অফিস থেকে একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে। তাতে তিনি বলেছেন, ঘটনা যাই হোক, পদত্যাগ করবো না। লড়াই ছাড়া আত্মসমর্পণ করবো না। ‘ক্রকিজ’দের চাপের ফলে কেন তিনি পদত্যাগ করবেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু তার দলের প্রায় ২০ জন এমপি (এর মধ্যে অল্প কিছু আছেন জোটের শরিক) বেঁকে বসেছেন। তারা বলেছেন, বিরোধীদের উত্থাপিত অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেবেন। এ অবস্থায় কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিরোধী এমপি বলছেন, পাকিস্তানের শক্তিধর সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। চার বছর আগে তাদের আশীর্বাদে ইমরান প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন বলে বলা হয়। কিন্তু এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন ইমরান খান। রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনীও। বিরোধী রাজনীতিকরা ইমরান খানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছেন তাতে অর্থনীতি এবং পররাষ্ট্রনীতিতে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ করেছেন। তবে ইমরান এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এখানে উল্লেখ্য, পাকিস্তানে এ পর্যন্ত কোনো প্রধানমন্ত্রীই তার পাঁচ বছরের ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। এ অবস্থায় ইমরান খান সেই রেকর্ড প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছিলেন। তা পূরণ করতে হলে তাকে ৩৪২ আসনের পার্লামেন্টে কমপক্ষে ১৭২ জন সদস্যের সমর্থন পেতে হবে। জাতীয় পরিষদের নিম্নকক্ষে বিরোধীদের সম্মিলিত আসন আছে ১৬৩টি। ১৭২ পূর্ণ করতে হলে তাদের প্রয়োজন হবে আরও ৯টি আসন। যদি দলত্যাগীরা ভোট দিতে পারেন এবং সেই ভোট গণনা করা হয়, তাহলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা আছে ইমরান খানের সামনে। এক্ষেত্রে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্সের জবাবে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হয়েছে। সেখানে পাঁচ বিচারকের বেঞ্চের নেতৃত্বে ছিলেন পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল। তিনি এদিন তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট চলাকালে যে ভোট দেয়া হবে, তা গণনা না করা হবে অবমাননাকর। বাস্তব প্রশ্ন হলো জাতীয় পরিষদের ভিন্ন মতাবলম্বী একজন সদস্যকে কতদিন অযোগ্য রাখা যাবে। তিনি পর্যবেক্ষণে বলেন, দলত্যাগের ঘটনায় একজন পার্লামেন্টারিয়ান অযোগ্য হবেন কিনা তার বর্ণনা রয়েছে সংবিধানের ৬৩(এ) ধারায়। এই শুনানিতে বেঞ্চে অন্য যেসব বিচারক উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন, বিচারক ইজাজুল আহসান, মাজহার আলম খান মিয়াখেল, মুনিব আখতার ও জামাল খাল মন্দোখাইল। এই শুনানিতে নোটিশ দেয়া হয়েছিল পিটিআই’র আইনজীবী আলী জাফর, পাকিস্তান পিপল্‌স পার্টির (পিপিপি) আইনজীবী ফারুক এইচ নায়েক, পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএলএন) আইনজীবী মাখদুম আলী খান ও জমিয়তে উলেমায়ে ইসলাম ফজলের (জেইউআইএফ) আইনজীবী কামরান মুরতজা ও প্রশাসনের অন্যান্যরা।
পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন জোটের মূল শরিকরা হলো- পিটিআই, মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম), পাকিস্তান মুসলিম লীগ কায়েদে আযম (পিএমএলকিউ), বেলুচিস্তান ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স, (জিডিএ), আওয়ামী মুসলিম লীগ (এএমএল) ও জামহুরি ওয়াতান পার্টি (জেডব্লিউপি)। এর মধ্যে পিটিআই’র আসন আছে ১৫৫টি।এমকিউএম’র আছে ৭ আসন। পিএমএলকিউ’র আছে ৫টি আসন। বিএপি’র আছে ৪টি আসন। জিডিএ’র আছে ৩টি আসন। এএমএল’র আছে ১ আসন ও জেডব্লিউপি’র আছে ১টি আসন। শেষ তিনটি দল জিডিএ, এএমএল ও জেডব্লিউপি যোগ দিয়েছে বিরোধীদের সঙ্গে। এদেরকে নিয়ে ইমরানের মাথাব্যথার কারণ নিজ দলের এমপি জাহাঙ্গীর তারিন। তার নেতৃত্বে বেঁকে বসেছেন পিটিআই’র প্রায় ২০ জন সদস্য। ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলিম খানও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ঘোষণা দিয়েছেন তিনিও জাহাঙ্গীর তারিনের গ্রুপে যোগ দিচ্ছেন।
অন্যদিকে বিরোধী জোটের যোগ দেয়া ক্ষমতাসীন জোটের সদস্যদের নিয়ে মোট আসন সংখ্যা ১৬৬। এর মধ্যে আছে পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজের (পিএমএলএন) ৮৪ আসন। পিপিপি’র ৫৬ আসন। মুত্তাহিদা মজলিশে আমালের (এমএমএ) ১৫ আসন। বেলুচিন্তান ন্যাশনাল পার্টির ৪টি আসন। গ্র্যান্ড ডেমোক্রেটিক এলায়েন্সের ৩টি আসন। আওয়ামী মুসলিম লীগের ১ টি আসন। আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির ১টি আসন। জামহুরি ওয়াতান পার্টির একটি আসন। আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির একটি আসন। আর নিরপেক্ষ আসন আছে ৪টি। এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি ক্ষমতাসীন জোটে থাকা তিনটি দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ কায়েদে আযম (পিএমএলকিউ), মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম) ও বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি)। যথাক্রমে এ দলগুলোর আছে ৫, ৭ ও ৪টি আসন। যদি এই দলগুলো বিরোধী শিবিরে যোগ দেয় তাহলে বিরোধী শিবিরে মোট পার্লামেন্ট সদস্যের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে (১৬৬+১৬)= ১৮২। যদি তাই হয় তাহলে ম্যাজিক সংখ্যা ১৭২ পেরিয়ে যাবে তারা। এখন কি ঘটে ইমরান খানের ভাগ্যে তার জন্য হয়তো অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েকদিন।