সবাই আসলো তুই কেন আসলি না?

0

বিশেষ সংবাদদাতা॥ বুধবার দুপুর ১টা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিআইপি গেটে কান্নার শব্দ। মেঝেতে লুটিয়ে গড়াগড়ি করছেন এক যুবক। তার আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ। এ চিত্র দেখে সবার চোখে পানি। ‘ভাই সবাই আসলো, তুই কেন আসলি না। আমার ভাই কই, আমার ভাই আসে না কেন, আমার ভাই কবে আইবো, আমার ভাইরে আইনা দাও-’ এভাবেই চিৎকার করছিলেন ইউক্রেনে আটকে পড়া বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে রকেট হামলায় নিহত থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্স। শুধু প্রিন্স নয়, বিলাপ করছেন তার বাবা রাজ্জাক হাওলাদার, মা রাশিদা বেগম ও সঙ্গে থাকা আরেক ছোট ভাই। তাদের কান্নায় বিমানবন্দরে উপস্থিত সবার মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। হাদিসুরের স্বজনের কান্নায় উপস্থিত অনেকের চোখ ভিজে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ছুটে আসেন বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মীরাও। শেষবারের মতো সন্তানের মুখ দেখার আকুলতা হাদিসুরের স্বজনদের। নিহত হাদিসুরের বাবা ছেলের ছবি বুকে নিয়ে ছেলের নাম ধরে ডাকছিলেন আর কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যাচ্ছিলেন। বলছেন জাহাজের সবাই ফিরেছে, কেবল খালি হয়েছে হাদিসুরের বাবা-মা’র বুক।
আজ হাদিসুরের সহকর্মীরা দেশে ফিরে আসবে এমন সংবাদ পেয়ে বরগুনার বেতাগী থেকে ছুটে এসেছিলেন তার বাবা-মা, ভাই ও স্বজনরা। তবে সবাই আসলেও আসেনি একজন। জীবিত হাদিসুর বা তার লাশ, কোনোটিই আসবে না জেনেও বিমানবন্দরে ফেরত আসাদের মধ্যে মা-বাবা খুঁজছেন তার পরম আদরের সন্তানকে, ভাই খুঁজছেন প্রিয় ভাইকে। হাদিসুরের মা রাশিদা বেগম বিলাপ করছেন আর বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। বলেন, ‘আমি আমার বাবারে চাই। সবাই আইছে আমার সন্তান আমি দেখি নাই। গত বুধবার তার সঙ্গে শেষ কথা হয়েছে। আমি তো অসুস্থ। ছেলে আমারে ডাক্তার দেখাইতে কইছে। বলছে মা আপনি সুস্থ হইছেন? আমি বলছিলাম আমি সুস্থ। তখন সে বলেছিল মা বেশি বেশি খাবেন। তাহলে সুস্থ হইবেন, শরীর ভালো থাকবে। তারপর একটা হাসি দিয়েছিল। সেই এখন আর নাই। আমার সংসার এখন নিঃস্ব। ওই ছেলেই ডাক্তার খরচ, খাবারসহ পুরো সংসার চালাইতো। এখন তো আর আমার খরচ আসবে না। সরকারের কাছে এখন এটাই আমাদের দাবি। আমার অপর তুই ছেলেকে যেন সরকার কর্মসংস্থান করে দেয়। আমার সন্তানের মরদেহ যেন আমি দেখতে পাই। ওরে বাবা, তুই কেন আসলি না। সবাই তো আসলো। বলতে বলতে আহাজারি করেন তিনি।’
নিহত ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্স মেঝেতে গড়াগড়ি করে কান্না, আহাজারি বিলাপ করছিলেন। আর বলছিলেন, ও ভাই সবাই তো ফিরে আসলো তুই কেন ফিরলি না। তোকে ছাড়া কতোটা কষ্ট বুকের ভেতরে, রাতে ঘুমাতেও পারছি না। শুধু তোকে খুঁজি। আমার ভাই হাদিসুর রহমান নিজে কষ্ট করেছে, আমাদেরকে কখনো কষ্টে রাখে নাই। আজ আমাদের সব শেষ রে ভাই। আমাদের সব শেষ। আপনারা আমার ভাইরে আইনা দেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি ব?লেন, বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি আমার ভাই (মরদেহ) আসবে। আমার ভাই, কখন আসবে সেটা জান?তে চাচ্ছি। কিন্তু তারা কিছুই বলছে না। ভাই কেন আসলো না। বলতে বলতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন প্রিন্স। আর বার বার ভাই, ও ভাই বলে চিৎকার করতে থাকেন। হাদিসুরের বাবা রাজ্জাক হাওলাদার একইভাবে বলেন, আমার ছেলের লাশ কোথায় আছে জানি না। একবার শুনি রোমানিয়া, একবার শুনি ইউক্রেন। শুনছি রোমানিয়াতে জানাজা হইছে। সঠিক খবর জানি না। আমার ছেলে?রে আইনা দাও, আইনা দাও। শুনছিলাম আজকে আসবে, আইসা শুনি আসে নাই। আমরা এখন কাকে নিয়ে বাড়ি যাবো। আমার তো সব শেষ। কেডা আমার বুকের মানিকটাকে কাইড়া নিলো। আমরা কি অপরাধ করেছি। ছেলের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার আকুতি জানিয়ে রাজ্জাক হাওলাদার বলেন, ‘সরকার আমার ছেলের লাশটা আইনা দিক। আর কোনো চাওয়া নাই। লাশটা একবার দেখতে চাই।’