বেড়েছে খুন, কিশোর অপরাধও থামছে না

0

ফাহিমা আক্তার সুমি॥ রাজধানীতে বেড়েছে খুনের ঘটনা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে খুন হচ্ছে মানুষ। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্রমাগত বাড়ছে অপরাধও। পারিবারিক কলহ, বিরোধ, পূর্ব-শত্রুতার জের, পরকীয়া, ছিনতাই, কথা কাটাকাটি ও বিভিন্ন ব্যক্তিস্বার্থের ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে একের পর এক ঘটছে হত্যাকাণ্ড। সেইসঙ্গে বাড়ছে এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসী তৎপরতা। কোনো কোনো মামলার আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও কমছে না হত্যাকাণ্ড। কিশোররাও জড়িয়ে পড়ছে খুনের মতো অপরাধে। দিনদিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এসব কিশোর অপরাধীরা। গত ১১ মাসে ঢাকায় বিভিন্ন ঘটনায় অন্তত ১৫২টি খুন হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি খুন হয়েছে মে এবং সেপ্টেস্বর মাসে।
অপরাধ ও সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিদিন ঘটে যাওয়া এই খুনের পেছনে রাজনৈতিক সহিংসতা, মাদক বাণিজ্য, অসহিষ্ণু আচরণ, ক্ষোভ, পরকীয়া, নৈতিকতার অবক্ষয় এবং জমিসংক্রান্ত বিরোধের কারণে দিন দিন খুনের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন তুচ্ছ ঘটনাকেও কেন্দ্র করে ঘটছে খুনের ঘটনা। কিশোরদের মধ্যে এই ধরনের অপরাধ প্রবণতাও দেখা দিয়েছে। তারা অধিক ইন্টারনেট ব্যবহারে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য মতে, ২০২১ সালের গত এগারো মাসে ১৫২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ১৮টি, ফেব্রুয়ারিতে ১২টি, মার্চে ৭টি, এপ্রিলে ১৮টি, মে ১৯টি, জুনে ১০টি, জুলাইতে ৮টি, আগস্টে ১৩টি, সেপ্টেম্বরে ১৯টি, অক্টোবরে ১৭টি, এবং নভেম্বরে ১১টি। গত ৩রা সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাতে আদাবর থানার শেখেরটেক এলাকায় পূর্ব শত্রুতার জের ধরে কতিপয় দুষ্কৃতকারীরা আব্দুল আজিজ নামে একজনকে ছুরিকাঘাতে খুন করে। এ ঘটনায় ৪ সেপ্টেম্বর ভুক্তভোগীর বাবা একটি মামলা করেন। মামলাটির তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগ। বিভিন্ন প্রযুক্তির সহায়তায় মঙ্গলবার অভিযুক্তের অবস্থান শনাক্ত করে বিকাল সাড়ে চারটায় আদাবর থানার শেখেরটেক এলাকায় অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত দীপুকে গ্রেপ্তার করে বলে পুলিশ জানায়। এ ঘটনায় জড়িত অপর একজন কিশোর অপরাধীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগানে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ করে পরিবার। মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, গত ৭ই জানুয়ারি সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টার দিকে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর মা কর্মস্থলের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে যান। ঘণ্টাখানেক পরে তার বাবাও বের হন। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ওই শিক্ষার্থী তার মা’কে ফোন করে কোচিং থেকে পড়ালেখার পেপার্স আনার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। মামলার একমাত্র আসামি ও’লেভেল পড়ুয়া শিক্ষার্থী দুপুর আনুমানিক ১টার দিকে ফোন করে ওই শিক্ষার্থীর মা’কে জানান, মেয়েটি তার বাসায় গিয়েছিলেন। হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়ায় তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর মা হাসপাতালে পৌঁছান। হাসপাতালের কর্মচারীদের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, আসামি তার কলাবাগান ডলফিন গলির বাসায় ডেকে নিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে অচেতন হয়ে পড়লে বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আসামি নিজেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। এদিকে ৩১শে মে রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় নৃশংসভাবে খুন হন নারী চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান লিপি। তিনি গ্রিন লাইফ হাসপাতালের রেডিওলোজি বিভাগের চিকিৎসক ছিলেন। তাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর বিছানায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। দাহ্য পদার্থ না থাকায় আগুন তেমন ছড়ায়নি। তবে সাবিরার শরীরের কিছু অংশ এতে দগ্ধ হয়। নিহতের পিঠেও দু’টি ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। পুলিশের ধারণা এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কলাবাগানের ৫০/১ ফার্স্ট লেনের বাড়ির নিজ ঘর থেকে লাশ উদ্ধার করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, বর্তমান সময়ে খুনের ঘটনাগুলো বেড়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতায়। একপক্ষ অপর পক্ষকে হামলা করছে। এসব অস্থিরতার কারণে আমাদের খুনের মতো অপরাধগুলো বাড়ছে। আরেকটি পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়ের সূত্র ধরে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটনাগুলো বাড়ছে। এদিকে আবার সম্পর্ককেন্দ্রিক ইস্যুগুলোকে ছোট করে ধরা যাবে না। সেটি একসময় বড় আকার ধারণ করে। পরস্পরের বিশ্বাসের জায়গাগুলো যখন কেউ শতভাগ পূরণ করতে অথবা প্রত্যাশিত মাত্রা অর্জন করতে পারে না তখন এই ধরনের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে মাদককেরও সংশ্লিষ্টতা আছে। মাদক নিয়ন্ত্রণকেও কেন্দ্র করে খুনের ঘটনা বাড়ছে। বিশেষ করে যারা মাদকের বাহক, যারা এই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত তারাও বিভিন্ন সময় দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে খুন হয়। তিনি আরও বলেন, সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সময় সম্পত্তি নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে কোনো মীমাংসায় আসতে না পারা, একে-অপরকে সম্মান না করা, ছোট করে দেখা বা আঘাত করার বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা ঘটে। প্রতিটি সমাজে কমবেশি এই ঘটনাগুলো ঘটতে দেখা যায়। আমাদের সমাজ কাঠামোর মধ্যে দিয়ে মানুষকে সত্যিকার অর্থে যে মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সেই কাজটি আমরা করতে পারছি না। সরকার বা জনগণ সেইভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। এ ব্যাপারে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে মানুষের সম্পৃক্ততা বা দায়িত্ব পালনের শিকড়। প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব মানুষকে মানবিক বোধসম্পন্ন করে তাকে তৈরি করা। সঠিক জ্ঞানগুলো তাকে প্রদান করা। সেটি বিভিন্ন ভাবে করা যেতে পারে। একটি সমাজ তখনই কাঙ্ক্ষিত সমাজ হয়, যখন সমাজের সর্বস্তরের অংশীদাররা তার নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, কিশোরদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলেও তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। গেমস ও বিভিন্ন কন্টেন্ট রয়েছে সেগুলো যখন কিশোররা দেখে তার মধ্যে একটা সহিংসতার শিক্ষণ চলে আসে। পরবর্তীতে যখন তার প্রতিপক্ষ বা কারও সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে কথাকাটাকাটি অথবা মনোমালিন্য হয় তখন ওই অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে। সেক্ষেত্রে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করা দেশে মনে হয় না কারও আছে। আমরা চাইলে ইন্টারনেটের এই কন্টেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি কিন্তু সেটি আমরা করছি না। কেন করছি না এর উত্তর দায়িত্বশীলরাই দিতে পারবেন। তরুণ সমাজ এই বয়সে সিদ্ধান্তহীনতায় থাকে। সে বুঝতে পারে না কোনদিকে যাচ্ছে। এগুলো ঠিক করতে দায়িত্ব পালনের জায়গা হলো পরিবার, অভিভাবক, শিক্ষক ও সমাজের। বিশেষ করে সরকার এখানে সঠিক কৌশলটা প্রয়োগ করতে পারেন। এইসব জায়গাগুলোতে আমাদের অনেক ঘাটতি আছে। এই কারণে তরুণরা খুন ও সহিংসতায় সহজে জড়িয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তারা অপরাধের শিক্ষা পাচ্ছে। একটি কাঙ্ক্ষিত এবং প্রত্যাশিত সমাজ তৈরি করতে গেলে সেটি সকল মানুষের যেমন দায় আছে সেটি এড়িয়ে গেলে যেমন তৈরি হবে না আবার সেই দায়িত্বকে সঠিকভাবে পালনের জন্য রাষ্ট্রের যে পরিকল্পনা এবং কৌশল নির্ধারণ করা দরকার সেই জায়গা থেকে আমাদের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। এই ঘাটতিগুলোকে পূরণ করে মানুষের দায়িত্ব ও সম্প্রীতি দ্বারা তত দ্রুত আমাদের খুন থেকে শুরু করে অন্যান্য যে অপরাধগুলো আছে সেটি কমে যাবে। আমাদের সব ধরনের আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও এ বিষয়ে বেশি নজর দিতে হবে। সবার আগে মানুষকে মানুষ হওয়া বেশি প্রয়োজন। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় আমরা সবসময় সতর্ক আছি। তুচ্ছ ঘটনাসহ নানা কারণে খুনের ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। একেবারে অপরাধ কখনো নির্মূল করা যায় না। মাদক ও সব ধরনের অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সবসময় সর্তক অবস্থানে আছেন।