অভিবাসী সঙ্কট : বেলারুস-পোল্যান্ড ‘সশস্ত্র’ সংঘাতের আশঙ্কা

0

ণোকসমাজ ডেস্ক॥ পোল্যান্ড হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে অভিবাসন প্রত্যাশী শত শত মানুষকে পোল্যান্ড সীমান্ত দিয়ে ঢুকতে উৎসাহিত করে উত্তেজনা বৃদ্ধিতে উস্কানি যোগাচ্ছে বেলারুস এবং এর ফলে দুই দেশের সীমান্তে ‘সশস্ত্র’ সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া কেটে শত শত মানুষ পোল্যান্ডে ঢোকার চেষ্টা করার পর পোল্যান্ড সেখানে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করেছে। পোল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটো বলছে বেলারুস এই সমস্যা সৃষ্টি করছে। বেলারুসের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। পোল্যান্ড কুজনিচায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি সীমান্ত পারাপার চৌকি বন্ধ করে দিচ্ছে। ইইউ এবং ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়া বলছে, সাম্প্রতিক কয়েক মাসে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী বেলারুস থেকে অবৈধভাবে তাদের দেশে ঢোকার চেষ্টা করেছে। এদের বেশিরভাগই আসছে মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার দেশগুলো থেকে।
‘বহু অভিবাসীর সাথে সশস্ত্র ব্যক্তি’
সীমান্ত এলাকায় এখন রাতের বেলা তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে নেমে যাচ্ছে এবং ইতোমধ্যেই সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েকজন অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ইইউ জোটের বাইরের দেশ বেলারুস আর তার প্রতিবেশী ইইউ দেশগুলোর মধ্যে রাজনীতির খেলায় এই অভিবাসীদের দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এদের বেশিরভাগই তরুণ এবং এদের মধ্যে নারী এবং শিশুও রয়েছে। পোল্যান্ডের সরকারি মুখপাত্র পিওতোর মুলার বলেছেন, পোল্যান্ডের পূর্ব দিকের সীমান্তের কাছে চার হাজার অভিবাসী জড়ো হয়েছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, তাদের ধারণা ঘটনা যেদিকে এগোচ্ছে তাতে এই উত্তেজনা বেড়ে ‘সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেবে’। পোল্যান্ডের টিভিতে বলা হয়েছে কুজনিচা সীমান্তের কাছে যেসব অভিবাসী জড়ো হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগের সাথেই অস্ত্রধারী ব্যক্তি এবং কুকুর রয়েছে। পোল্যান্ডের জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান স্ট্যানিসলো জারিন বলেছেন, এই অভিবাসীদের নিয়ন্ত্রণ করছে বেলারুসের সশস্ত্র ইউনিটগুলো। বেলারুস চাইছে একটা বড় ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হোক – তারা সম্ভবত চাইছে গুলি চলুক এবং মানুষ হতাহত হোক,’ এর আগে একথা বলেন পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিওতোর ওয়ারজিক।
ইইউ’র অভিযোগ প্রত্যাখ্যান বেলারুসের
বেলারুসের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পোল্যান্ডের এসব বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, এসব ভিত্তিহীন এবং এর পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। তারা অভিযোগ করেছে, সীমান্তে হাজার হাজার সৈন্য সমাবেশ করে পোল্যান্ড ওয়ারস চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অভিযোগ করছে, বেলারুসের ওপর ইইউ জোটের দেয়া নিষেধাজ্ঞার বদলা নিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো অভিবাসীদের এই ঢল ইইউ’র দিকে ঠেলে দেবার উদ্যোগ নিয়েছেন।
নিষেধাজ্ঞার পরিধি বাড়াতে চায় ইইউ
বেলারুসে গত বছর বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ তোলা প্রতিবাদকারীদের গণবিক্ষোভের ওপর লুকাশেঙ্কোর দমন-পীড়ন এবং রায়ানএয়ারের একটি বিমানকে মিনস্কে নামতে বাধ্য করে বিমানের ভেতর থেকে ভিন্নমতাবলম্বী একজন সাংবাদিককে গ্রেফতার করার পর দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইইউ। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েন বলেছেন, ইইউ এই নিষেধাজ্ঞার পরিধি বাড়িয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের বেলারুসে নিয়ে যাচ্ছে যেসব ‘তৃতীয় দেশের বিমানসংস্থা’ তাদের এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার বিষয়টি এখন বিবেচনা করবে। লুকাশেঙ্কো বারবার হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, তার সরকার অভিবাসীদের ঢল ঠেকাতে আর কোনো পদক্ষেপ নেবে না। তিনি অভিযোগ করেন, প্রতিবেশী ইইউ দেশগুলো অভিবাসীদের প্রতি সহিংস আচরণ করছে। জার্মানি মঙ্গলবার ইইউর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, পোল্যান্ডকে তাদের সীমান্ত সুরক্ষিত করতে সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে ইইউ যেন ‘পদক্ষেপ গ্রহণ করে’। ন্যাটো সামরিক জোট বলেছে, বেলারুস কর্তৃপক্ষ এই অভিবাসীদের রাজনৈতিক বিতণ্ডায় দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করছে। আমেরিকাও লুকাশেঙ্কোকে ‘অভিবাসীদের এই অবৈধ স্রোত এবং তাদের জোর করে সীমান্তের দিকে ঠেলে দেয়ার উদ্যোগ অবিলম্বে বন্ধ করার’ আহ্বান জানিয়েছে। লিথুয়ানিয়াও বেলারুসের সাথে তাদের সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করেছে, সেখান দিয়ে তাদের দেশে সম্ভাব্য অভিবাসীদের ঢল ঠেকানোর প্রস্তুতি হিসেবে।
সীমান্তে বেড়া ভাঙার দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে
সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, অভিবাসীদের দল সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে পোল্যান্ডে ঢোকার চেষ্টা করছে, এবং পোল্যান্ডের সীমান্ত রক্ষীরা তাদের আটকাচ্ছে।
সামাজিক মাধ্যমেই পরিকল্পনা
অভিবাসন প্রত্যাশী ও শরণার্থীদের বেলারুসে ঠেলে ফেরত পাঠাতে পোল্যান্ডের নেয়া কঠোর পদক্ষেপের সমালোচনা করা হচ্ছে। এদিকে, পোল্যান্ড তাদের বেলারুসের দিকে ঠেলে দেয়ায় এবং বেলারুস তাদের ফেরত নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় এই অভিবাসীরা পোল্যান্ডের জঙ্গল এলাকায় আটকে পড়েছেন। প্রচণ্ড শীতে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকজন মারা গেছে। বিবিসির পল অ্যাডামস কথা বলেছেন পোলিশ সীমান্তে এক ইরাকি অভিবাসীর ভাই বারোয়া নুসরেদ্দিন আহমেদের সাথে, যিনি স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে সীমান্ত এলাকায় রয়েছেন। তারা বেলারুসের রাজধানী মিনস্কে এসে পৌঁছেছেন গত মাসে। সীমান্তে যারা আটকে আছেন খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে তারা খুবই কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন নুসরেদ্দিন আহমেদ। তিনি জানান, সোমবার সীমান্ত চৌকির কাছে জড়ো হবার পরিকল্পনা অভিবাসীরা নিজেরাই করেছিলেন সামাজিক মাধ্যমে। তবে তিনি একথাও বলেন যে বেলারুস এ কাজ করতে তাদের উৎসাহ দিয়েছে। ‘মানুষ জানে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু তাদের তো ভবিষ্যতের জন্য আর কোনো পথ নেই,’ বলছেন নুসরেদ্দিন আহমেদ। সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা গেছে, সোমবার নারী ও শিশুসহ বিশাল মানুষের দল পায়ে হেঁটে পোল্যান্ড সীমান্তের দিকে এগোলে প্রবল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। অন্য কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, বেশ বড় সংখ্যক অভিবাসীদের পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে খাকি পোশাক পরা কিছু সশস্ত্র ব্যক্তি। বেলারুসের সীমান্ত রক্ষী সংস্থা এর আগে রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে জানায় যে দু হাজারের বেশি ‘শরণার্থী’ ইইউতে ঢোকার জন্য পোল্যান্ডের সীমান্তের সামনে জড়ো হয়েছে। তারা ইইউ অভিমুখে যাচ্ছে, ‘যেখানে তারা সুরক্ষা পেতে আবেদন করতে চান’ বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।
সূত্র : বিবিসি