সংঘর্ষের পর পুরুষশূন্য জগদল গ্রাম, ঘরবাড়ি পাহারায় আত্মীয়রা

0

মাগুরা সংবাদদাতা॥ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মাগুরায় চার খুনের ঘটনার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও গ্রামবাসীর মধ্যে এখনো আতঙ্ক কাটেনি। হামলা ও গ্রেফতার আতঙ্কে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে সদর উপজেলার জগদল গ্রাম। বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া কোনো পুরুষই এখন পর্যন্ত গ্রামে ফিরে আসেননি। দূর-দূরান্ত থেকে নারী আত্মীয়স্বজনরা এসে বাড়িঘর পাহারা দিচ্ছেন। আগামী ১১ নভেম্বর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শুক্রবার (১৫ অক্টোবর) সদর উপজেলার জগদল ইউনয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বার নজরুল ইসলাম ও সৈয়দ আলী হাসান সমর্থিত দুই গ্রুপের সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। এসময় উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হন। নিহতদের মধ্যে একই পরিবারের তিন ভাই রয়েছেন। ঘটনার তিনদিন পর সোমবার (১৮ অক্টোবর) দুপুরে ৬৮ জনকে আসামি করে মাগুরা সদর থানায় মামলা করেন নিহত সবুর মোল্যার ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন মোল্যা। অন্যদিকে মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে নিহত ইমরানের মা ফরিদা বেগম বাদী হয়ে ৫২ জনকে আসামি করে আরেকটি মামলা করেন। বুধবার (২০ অক্টোবর) সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, জগদল গ্রামের রাস্তা ফাঁকা। কোথাও মানুষের উপস্থিতি নেই। পুলিশ টহল দিচ্ছে।
এলাকার নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার দিন থেকে তাদের বাড়ির পুরুষ সদস্যরা গ্রেফতার আতঙ্কে বাড়ি ছেড়েছেন। পরবর্তী হামলা ও লুটপাটের ভয়ে তারা বাড়ির আসবাবপত্র ধান, চাল, গবাদিপশু নিরাপদ স্থানে তাদের আত্মীয়দের বাড়িতে সরিয়ে দিয়েছেন। জগদল গ্রামের আইয়ুব হেসেনের স্ত্রী হেলেনা বেগম বলেন, এলাকায় খুন হয়েছে। তাই গ্রেফতারের ভয়ে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা গ্রাম ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গেছেন। লুটপাটের ভয়ে তার বাড়ির ফ্রিজসহ মূল্যবান জিনিসপত্র পার্শ্ববর্তী গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে এসেছেন। পার্শ্ববর্তী আমুড়িয়া গ্রামের আশরাফুল আলম বলেন, চারজন নিহত হওয়ার ঘটনায় তার আত্মীয়রা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। তাই তিনি আত্মীয়ের বাড়ি পাহারা দিতে এসেছেন। ভ্যানচালক মালেক বলেন, তিনি মাগুরা শহরে থেকে রিকশা চালান। কিন্তু গ্রামে হত্যার ঘটনায় লুটপাট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই তিনি তার বাড়ির জিনিসপত্র সরিয়ে নিয়েছেন। জগদল গ্রামে টহলরত পুলিশ সদস্য নেওয়াজ হোসেন বলেন, এলাকার পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত আছে। মার্ডার হওয়ায় গ্রামটি পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। বাড়িতে শুধু নারীরা আছেন।
তবে নিহত সবুর মোল্যার স্ত্রী মিলিনা বেগমের অভিযোগ, তার সামনে স্বামী সবুরকে নজরুল ও তার সমর্থকরা গলা কেটে হত্যা করেছেন। নজরুল এ হত্যা মামলা থেকে রক্ষা পেতে অপর নিহত ইমরানের পরিবারকে জিম্মি করেছেন। এখন তার (নিহত ইমরান) মাকে দিয়ে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে নিরীহ মানুষদের আসামি করে মামলা করেছেন। তিনি নজরুলসহ দোষীদের গ্রেফতার ও ফাঁসি দাবি করেন। নিহত ইমরান হোসেনর মা ফরিদা বেগম জানান, ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে ৫২ জনকে আসামি করে তিনি মামলা করেছেন। ছেলে নিহত হওয়ার পর তার স্বামীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নিহত সবুরের ভাই হাবিবুর বলেন, দুর্বৃত্তরা আমার আপন দুই ভাইসহ চারজনকে হত্যা করলো। এর আগেও এই দুবৃর্ত্তরা ২০০৩ সালে আমার আরেক আপন ভাই জরিপ মোল্ল্যাকে হত্যা করে। প্রভাবশালীদের চাপে আমরা মামলা তুলে নিতে বাধ্য হই। সেদিন জরিপ ভাইয়ের হত্যাকারীদের বিচার হলে এখন আবার আরও দুই ভাইকে হারাতাম না। ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
জগদল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, এর আগে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এই দুই গ্রুপের মধ্যে বেশ কয়েকবার সংর্ঘষের ঘটনা ঘটে। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পার্টি অফিসে বসে তিনি ও স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ এলাকার গণ্যমান্যদের নিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করে দেন। এরপর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে আবার তারা সংর্ঘষে লিপ্ত হলে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। মাগুরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত (ওসি) কর্মকর্তা মঞ্জুরুল আলম বলেন, জগদল গ্রামে সংঘর্ষে চারজন নিহতের ঘটনায় দুই পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ চারজনকে গ্রেফতার করেছে। তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তার শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে গ্রামের জনসাধারণকে এলাকায় থাকতে বলা হয়েছে। এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। পরবর্তী সহিংসতা এড়াতে পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাগুরা সদর উপজেলার জগদল গ্রামে খুনের ঘটনা নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে ইউপি সদস্য নজরুল ও স্থানীয় মাতব্বর সবুর মোল্যার মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। ২০০৩ সালে এই দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন হয়েছিলেন আরও তিনজন। সে সময় প্রতিপক্ষ নজরুল গ্রুপের হামলায় সবুর মোল্যার বড় ভাই জরিফ মোল্যা নিহত হন। ওই ঘটনার মামলায় অন্যতম আসামি ছিলেন ইউপি সদস্য নজরুল ও তার লোকজন। এবারের নির্বাচনে সবুর মোল্যা সম্ভাব্য প্রার্থী সৈয়দ হাসানকে সমর্থন দিয়েছিলেন। এসব কারণেই হামলা ও সংঘর্ষ ঘটে। তারা আরও জানান, এলাকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য বিভিন্ন ওয়ার্ডে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশেষ করে সরকারদলীয় নেতাদের নেতৃত্বে পরস্পর বিরোধী একেকটি একেকটি সামাজিক দল গঠন হয়। যেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয় দলের সদস্যরাই থাকেন। এলাকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিরোধ সূত্রে তারা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিশেষ করে স্থানীয় নির্বাচনের সময় তা ভয়াবহ রূপ নেয়। শুক্রবারের সংঘর্ষটি সামাজিক দলাদলি নিয়ে সংঘটিত এরকমই একটি নৃশংস ঘটনা। এ নিয়ে ১৮ বছরে এ গ্রামে সাত খুনের ঘটনা ঘটলো।