অনলাইন জুয়ায় পাচার কোটি টাকা, বেটিং গ্রুপের সদস্যরাও নজরদারিতে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ দেশে অনলাইন জুয়াড়িদের বিশাল সিন্ডিকেট। আসক্ত হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক ব্যক্তি। কৌতুহলে শুরু হলেও কয়েকদিনেই নেশা হয়ে যায়। নানা বয়স ও পেশার মানুষ আছে আসক্তর তালিকায়। বড় কথা হচ্ছে, ঘরে বসেই দেশে ও দেশের বাইরের বিভিন্ন বেটিং বা জুয়ার সাইটে অংশ নিতে পারছে তারা। বেশিরভাগ সাইট পরিচালনা করা হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে। চাহিদা বাড়ায় প্রতিদিনই গজিয়ে উঠছে নতুন সাইট। এমনকি মোবাইল অ্যাপসও আছে এগুলোর। বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে। এসব অনলাইন জুয়ার প্লাটফর্মে নিঃস্ব হচ্ছে অনেকে। অনেকে হারাচ্ছে ক্রেডিট কার্ডের তথ্য ও ব্যালেন্স। এ ছাড়াও দেশের টাকা বাইরে পাচারের অভিনব পথ খুলে দিয়েছে অনলাইন জুয়া। এ জুয়ার কারণে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতিদিন লেনদেন হচ্ছে কোটি টাকা। জানা গেছে, দেশীয় দালালদের মাধ্যমে এই অর্থের দুই-তৃতীয়াংশই পাচার হচ্ছে বিদেশে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, ইতোমধ্যে চক্রের অনেক সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। বন্ধ করা হচ্ছে সাইট। যারা এখনও সক্রিয় তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
অনলাইন জুয়ার প্লাটফর্ম যেভাবে কাজ করছে
অনলাইন জুয়া আর সাধারণ জুয়ার মাঝে বিশেষ পার্থক্য নেই। এখানেও বিভিন্ন লিগ খেলাকে কেন্দ্র করে বেটিং তথা বাজি ধরা চলে। আয়োজকের ভূমিকায় থাকে একটি ওয়েবসাইট। সাইটগুলো নেট দুনিয়ায় ‘বেটিং সাইট’ নামে পরিচিত। দেশে বিভিন্ন নামে বেটিং সাইট রয়েছে। এসব সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে নিবন্ধিত হতে হয়। তারপর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কার্ড বা অন্য কোনও মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে জুয়ায় অংশ নিতে হয়। কমশিক্ষিত জুয়াড়িদের জন্য দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পাওয়া যায় দালাল চক্র। দালালরা অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়, বাজিতে অংশ নেওয়ার নিয়মও শিখিয়ে দেয়। এরপর চক্রটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা নিয়ে তা ডলারে রূপান্তরিত করে জুয়াড়িদের অ্যাকাউন্টে জমা করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই দালাল চক্র প্রকাশ্যেই জুয়া খেলতে মানুষকে আমন্ত্রণ জানায়। মূলত বিভিন্ন দেশের ফুটবল, ক্রিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের বড় খেলার আসর ও খেলোয়াড়দের নিয়ে এসব জুয়ার আসর বসে।
বিদেশি জুয়ার সাইটে দেশি দালাল
গত ৯ ডিসেম্বর ঢাকা জেলার সাভার থানা এলাকা থেকে অনলাইন জুয়াড়িদের একটি ফেসবুক গ্রুপের দুই এডমিনকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশ পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। গ্রেফতারকৃতরা হলেন মো. সাব্বির আহমেদ কাওসার (১৯) ও মো. মনোয়ার হোসেন (২৬)। এ সময় তাদের কাছ থেকে অনলাইন জুয়া খেলার বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। দুজনই রাশিয়া থেকে পরিচালিত ওয়ানএক্সবেট (1xbet) নামে একটি জুয়ার প্লাটফর্মের দেশি এজেন্ট। তারা আটজন মিলে বাংলাদেশে ওয়নএক্সবেটের হয়ে কাজ করে। এরা মানুষকে এই সাইটে ‍জুয়া খেলতে আইডি বা অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়, অ্যাকাউন্টে টাকা রিচার্জ করে দেয়। তাদের ফেসবুকের এডমিন ও মডারেটর মোট আটজন। গ্রুপে সদস্য আছে দশ হাজার। ওই সদস্যরাও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর নজরদারিতে আছে বলে জানা গেছে। এটিইউ -এর পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চক্রটি ২০১৬ সাল থেকে অনলাইন বেটিংয়ের সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ করে অনলাইনে জুয়া খেলতে মানুষকে আমন্ত্রণ জানায়। এরপর বিদেশি বেটিং সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়, জুয়াড়িদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেটা ডলারে রূপান্তরিত করে অ্যাকাউন্টে জমা করে দেওয়ার পর বেটিং বা জুয়া খেলা শুরু করা যায়। চক্রের আট সদস্যের দুজনকে আমরা গ্রেফতার করেছি। এখনও পলাতক ছয়জন। তারাও শিগগিরই ধরা পড়বে।’
কারা খেলছে জুয়া?
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, সব বয়সী ও সব পেশার মানুষই জুয়ায় আসক্ত হতে পারে। একবার নেশা পেয়ে বসলে সহজে কেউ বের হতে চায় না। অধিকাংশই তরুণ। যারা মোবাইল গেমে বেশি আসক্তি তারা গেম এক্সপ্লোর করতে করতে একসময় জুয়ার বেটিং সাইটে চলে যায়। বাজি ধরা তখন নেশায় পরিণত হয়। রামপুরের রাশেদুল হাসান নামের এক তরুণ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক। সারাদিন দোকানেই বসে থাকি। হাতে মোবাইল থাকেই। গেম খেলে সময় কাটাই। একসময় বন্ধুদের মাধ্যমে অনলাইনে বেট ধরা শুরু করি। এটা করতে গিয়ে আজ আমি ফতুর হয়ে গেছি বলা যায়।’
বাংলাদেশে অনলাইন জুয়াড়ির সংখ্যা কত? এমন প্রশ্নের জবাবে রাশেদুল বলেন, ‘লাখ লাখ মানুষ খেলে। বিভিন্ন বেটিং সাইটে বিভিন্ন রকম নিয়ম রয়েছে। কোথাও কম টাকায় খেলা যায়, কোথাও সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা বা ১০০০ টাকা জমা রাখতে হয়।’ রাশেদুলের বক্তব্যের সঙ্গে পুলিশের তথ্যেরও মিল পাওয়া যায়। পুলিশ জানিয়েছে, দেশে প্রতিদিনেই বিভিন্ন ধাঁচের অনলাইন জুয়াড়িদের সংখ্যা বাড়ছে। সবাই নজরদারিতে রয়েছে।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন
জুয়াড়িরা মূলত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই লেনদেন করে থাকে। সম্প্রতি অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট যে চক্রটিকে গ্রেফতার করেছে, তারা দেশের সবগুলো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সুযোগ নিয়েছে। ওয়ানএক্সবেট-এর দেশি চক্রের আট সদস্যের দুই সদস্য ঢাকা থেকে গ্রেফতার হলেও বাগেরহাটসহ অন্যান্য কয়েকটি জেলায় বাকি সদস্যরা পলাতক। তারা রকেট, বিকাশ, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা নিতো। গ্রুপটি ওয়ানএক্সবেট সাইটে অ্যাকাউন্ট খোলা ও টাকা জমা দেওয়ার জন্য রীতিমত ফেসবুক ও ইউটিউবে বিজ্ঞাপনও দিত। অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট জানিয়েছে, চক্রের মোবাইল ব্যাংকিংয়ে কয়েক কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য রয়েছে।
অর্থপাচার
বিদেশি জুয়ার সাইটগুলোর এজেন্টরা জুয়াড়িদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে তা ক্রেডিট কার্ড ও ই-ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেটিং সাইটের মালিকদের কাছে পাচার করে। এরপর বেটিং সাইট ডলার পাবার পর জুয়াড়িদের অ্যাকাউন্টে সেই পরিমাণ প্রদর্শন করে। এভাবেই জুয়াড়িদের হাত ধরে পাচার হচ্ছে টাকা। আবার এজেন্টদের হাত ধরে হুন্ডির মাধ্যমেও অর্থপাচার হচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আশঙ্কা করছে।
ওয়েবসাইট-অ্যাপস কত?
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জানিয়েছেন, এ বছরের জুলাইতে চার হাজার জুয়ার সাইট বন্ধ করা হয়েছে। অনলাইনে বিভিন্ন ব্যক্তি দ্রুত লাভবান হওয়ার জন্য নামে-বেনামে এসব জুয়ার সাইট খুলে বসছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বন্ধ করলেও ভিন্ন নামে ফের চলে আসে। এখনও সক্রিয় রয়েছে শতাধিক জুয়ার সাইট।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য
অনলাইন জুয়ার প্লাটফর্ম বা ওয়েবসাইটের ডোমেইন ও হোস্টিংয়ের বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রিত হয় দেশের বাইরে থেকে। বিদেশে থাকা বাংলাদেশি নাগরিকদের কিছু চক্র আছে যারা বাইরে বসে এই সাইট পরিচালনা করে। তাই তাদের সহজে ধরা যায় না। তবে সাইটগুলো বাংলাদেশে যাতে না খোলে সেজন্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মাধ্যমে বন্ধের সুপারিশ করা হয়। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন-র‌্যাবের মুখপাত্র লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনলাইন বেটিং সাইটগুলো দেশের বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ হয়। আমরা ইতোমধ্যে সুপারিশ করে ৩২টি সাইট বন্ধ করিয়েছি। এসব সাইটের সঙ্গে দেশে যারা এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে, তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। আমাদের নজরদারি সবসময়ই রয়েছে।’