চীনের কূটনীতির কৌশল করোনা টিকা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ চীনের করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন দ্রুতই পাবে ফিলিপাইন। লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দেশগুলো ভ্যাকসিন কিনতে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ পাবে। বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ ডোজ পাবে বিনামূল্যে। গণব্যবহারের জন্য নিরাপদ একটি টিকা ব্যাপকহারে উৎপাদনের জন্য এখনো কয়েক মাস সময় লাগবে চীনের। কিন্তু তাতে দেশটির বয়েই গেছে। এই টিকাকে ব্যবহার করে মাঠে নেমে গেছে দেশটি। ক্ষতিগ্রস্ত সম্পর্ক মেরামত কিংবা বিভিন্ন অঞ্চলে নিজের স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে আরো ঘনিষ্ঠ করতে এই টিকাকে ব্যবহার করছে দেশটি।
উদাহরণ হিসাবে ইন্দোনেশিয়ার কথাই ভাবুন। দীর্ঘদিন ধরেই দেশটি বেইজিং-কে নিয়ে সতর্ক ছিল। গত সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডোর সঙ্গে এক ফোনালাপে চীনের নেতা শি জিন পিং আশ্বস্ত করে বলেন যে, টিকা সংক্রান্ত সহযোগিতায় ইন্দোনেশিয়ার উদ্বেগ ও প্রয়োজনের বিষয়টি চীন গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। টিকা উন্নয়নে দুই দেশের সহযোগিতাকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন উজ্জ্বল স্থান হিসাবে আখ্যা দেন তিনি। এর আগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাস্ক ও ভেন্টিলেটর পাঠিয়েছিল চীন।
আর এখন ভ্যাকসিনের প্রতিশ্রুতি। এই দুইয়ে মিলে চীন নিজেকে দায়িত্ববান নেতা হিসাবে তুলে ধরতে চায়, যখন যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক নেতৃত্ব থেকে ক্রমেই পিছু হটছে। ডিসেম্বরে চীনে করোনাভাইরাস যখন প্রথম দেখা দেয়, তখন চীনের কিছু ভুল পদক্ষেপের কারণেই বিশ্বব্যাপী করোনা ছড়িয়েছে, আর সেজন্য চীনা কম্যুনিস্ট পার্টিকে দায়বদ্ধ করা উচিৎ এই দাবির বিরুদ্ধেও চীনের এই ভ্যাকসিন কূটনীতি হয়তো কাজে দেবে। দরিদ্র দেশগুলোতে টিকা সরবরাহ করতে পারলে মহামারি-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় বিজ্ঞানের দিক থেকেও অন্যতম নেতা হিসাবে চীনের উত্থানের ইঙ্গিত মিলবে। পাকিস্তানের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ-এ চীনের দু’টি টিকা প্রস্ত্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ট্রায়াল আয়োজন করেছে। সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গাজালা পারভিন বলেন, ‘চীনা টিকা নিতে মানুষ খুবই আগ্রহী। মানুষ বরং আমাদের বলছে যতো দ্রুত সম্ভব টিকা প্রস্তুত করতে।’ কিছু কিছু মানদণ্ডে কোভিড-১৯ টিকা তৈরির যেই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা চলছে, সেখানে চীন এগিয়েই আছে, বর্তমানে দেশটির ৪টি পরীক্ষামূলক টিকার চূড়ান্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে, যা যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে ৩টি টিকা। মার্কিন কোম্পানি ফাইজার বলছে, অক্টোবর নাগাদ টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমতির জন্য আবেদন করা হবে। মডার্না বলছে, বছরের শেষ নাগাদ তাদের টিকা আসতে পারে। বৃটিশ-সুইডিশ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা এই সপ্তাহে তাদের শেষ মুহূর্তের বৈশ্বিক পরীক্ষা স্থগিত করেছে, কারণ একজন অংশগ্রহণকারীর শরীরে গুরুতর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
অপরদিকে চীন গত সপ্তাহেই দু’টি পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে। জুলাইয়ে সেনাবাহিনীর সদস্য ও রাষ্ট্র-মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর কর্মীদের ইতিমধ্যেই পরীক্ষামূলক এই টিকা দেয়া হয়েছে। খুবই নীরবে স্বাস্থ্যসেবাকর্মী ও বিমান যোগাযোগ খাতে কর্মরতদেরও এই টিকা দেয়া হয়েছে। দেশটির ভ্যাকসিন নির্মাতা কোম্পানিগুলো অসংখ্য কারখানা নির্মাণ করেছে, যেখানে লাখ লাখ টিকা উৎপাদন করা সম্ভব। শি জিন পিং ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন যে, ঘরোয়াভাবে উৎপাদিত এসব ভ্যাকসিন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবেন তিনি। চীন দীর্ঘদিন ধরেই বৈশ্বিক স্বাস্থ্যখাতে অবদান রাখাকে নিজের সফট পাওয়ার সুসংহত করার সুযোগ হিসাবে দেখে আসছে। র‌্যান্ড করপোরেশনের চীন বিশেষজ্ঞ জেনিফার হুয়াং বোয়ি বলেন, “সরকার নিশ্চিতভাবেই চায় যে চীন যেনো ভালো টিকা উৎপাদনে সক্ষম হয় ও অনেক দেশই এই টিকা চায়। চীনের কূটনীতির জন্য ও কোভিড নিয়ে চিন্তা-ভাবনা পরিবর্তনের জন্য এটি লাভজনক।”
তবে চীনা কোম্পানিগুলো যখন বিদেশে ট্রায়াল চালাতে গেছে তখন কিছু বিতর্ক উঠেছে। অনেকের আতঙ্ক ছিল যে, স্থানীয় বাসিন্দাদের গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া করোনাভাইরাস নিয়ে যেহেতু এখনো অনেক কিছু অজানা, তাই টিকা কাজে না লাগার আশঙ্কা সব সময়ই ছিল। কিন্তু এই অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে চীন তাদের সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী প্রচার করেছে। অনেক নড়বড়ে সম্পর্ক জোড়া লাগানোর কাজেও ব্যবহার করেছে। গত মাসে প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে এই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ভয়াবহ খরার জন্য চীন দায়ী। এসব সমালোচনার মধ্যেই তিনি ওই বৈঠকগুলো করেন। তিনি ওই দেশগুলোকে ভ্যাকসিন সরবরাহ করারও প্রস্তাব দেন, যেগুলো সবাই ভালোভাবে গ্রহণ করে। ওই একই সম্মেলনে কম্বোডিয়ার কট্টর চীন সমর্থক প্রধানমন্ত্রী হান সেন বেইজিং-এর ব্যাপক প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, টিকা প্রস্তুতিতে আমাদের বন্ধু চীনের প্রচেষ্টাকে আমরা অত্যন্ত সাদরে গ্রহণ করছি। এদিকে ফিলিপাইনে প্রভাব বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লড়ছে চীন। সেখানে প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতের্তে স্থানীয় আইনপ্রণেতাদের বলেছেন যে, তিনি শি জিন পিং-এর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন টিকার ব্যাপারে। তিনি এ-ও বলেছেন যে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের যেসব দাবি, তার বিরুদ্ধে তিনি লড়বেন না। একদিন পরই চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওউয়াং ওয়েনবিন জানান, ফিলিপাইনকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে টিকা দিতে সম্মত চীন। একই ধরনের প্রস্তাব আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশকেও দিয়েছে দেশটি। এসব অঞ্চলেই বেইজিং নিজের প্রভাব বৃদ্ধিতে আগ্রহী।
জুনে আফ্রিকান নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে শি জিন পিং বলেন, ‘আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, চীনে কোভিড-১৯ টিকার উন্নয়ন ও প্রয়োগ সম্পন্ন হলেই আফ্রিকান দেশগুলো হবে প্রথম উপকারভোগী দেশগুলোর অন্যতম।’ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই জুলাইয়ে প্রতিশ্রুতি দেন যে, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দেশগুলো যেন টিকা কিনতে পারে সেজন্য ১০০ কোটি ডলারের ঋণ দেয়া হবে। তবে টিকা সরবরাহ নিয়ে এতো কথা উঠলেও, চীন নিজস্ব শর্তেই এই টিকা বিতরণে রাজি। দরিদ্র দেশগুলোতে সহজে টিকা সরবরাহ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেই কোভ্যাক্স উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সেখানে যুক্ত হওয়া নিয়ে কিছু বলেনি চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন একেবারে সরাসরিই এই উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। গত সপ্তাহে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনইং বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই কিছু দেশের সঙ্গে সহযোগিতা করেছি। চীন সব সময়ই কথা রাখে।’ ভ্যাকসিন পাওয়ার এই প্রতিযোগিতায় চীন যদি জিতে, তবে এই সাফল্যের জন্য অন্য কিছু দেশকেও কৃতিত্ব দিতে হবে দেশটির। এসব দেশ নিজেদের মানুষের ওপর চীনা ভ্যাকসিনের পরীক্ষা হতে দিয়েছে। চীনের ওষুধ প্রস্তুতকারকরা পরীক্ষার জন্য বিদেশে গিয়েছেন কারণ দেশে ভাইরাসের বিস্তার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশে বেইজিং ভিত্তিক টিকা প্রস্তুতকারক সিনোভ্যাক বায়োটেক ঢাকায় ৪২০০ স্বাস্থ্যসেবাকর্মীর ওপর টিকার পরীক্ষা চালাচ্ছে। বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়েরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ (আইসিডিডিআর,বি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. জন ডি ক্লিমেন্স বলেছেন, চীনা এই কোম্পানি বাংলাদেশকে ১ লাখ ১০ হাজার ডোজ বিনামূল্যে দিতে রাজি হয়েছে। আইসিডিডিআর,বি এই ট্রায়ালে সহায়তা করছে। তবে ১ লাখ ১০ হাজার ডোজ এশিয়ার দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি ও ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশের জন্য খুবই সামান্য। চীনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সত্ত্বেও বাংলাদেশীদের আশঙ্কা টিকার দাম এতো বেশি হবে যে তা মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে থাকবে। ঢাকার ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, ‘যদি পৃথিবীর কোনো মানুষ প্যাটেন্ট রাইট বা লাভ করার কারণে ভ্যাকসিন থেকে বঞ্চিত হয়, এটি হবে এই শতকের সবচেয়ে বড় অবিচার।’
বেইজিং-এ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জোর দিয়ে বলেছে যে, টিকা সরবরাহ নিয়ে একাধিপত্য বা মনোপলি তৈরি করা চীনের উদ্দেশ্য নয়। ভ্যাকসিনকে কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে চীন, এমন অভিযোগের বিরুদ্ধেও জোরেসোরে কথা বলেছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত মিডিয়াগুলো। সরকার সমর্থিত একাডেমিকরা বলছেন যে, টিকা সরবরাহের সঙ্গে স্বার্থ জড়িত নেই। চায়না ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট রুয়ান জোংজে বলেন, ‘নিশ্চিতভাবেই কোনো শর্ত এখানে থাকবে না। এটি হবে বিশ্বের মানুষের সম্পদ, তাই এখানে শর্ত যোগ করলে অন্য পক্ষের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হবে।’ কিন্তু তারপরও টিকা পাবে এমন কিছু দেশে এ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আঞ্চলিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোও মনে করছে, চীন মূলত প্রভাব বলয় বিস্তৃত করছে। নেপালে চীন একটি সিমেন্ট কোম্পানির ৫০০ শ্রমিকের ওপর পরীক্ষা চালাবে। স্থানীয় রাজনীতিকরা ইতিমধ্যেই স্বচ্ছতার অভাব ও ভ্যাকসিন কতোটা নিরাপদ তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। নেপালের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতা প্রকাশ শরণ মহৎ বলেন, ‘এই টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে আগে আমাদের আশ্বস্ত করা উচিৎ নয় কি?’ দক্ষিণ এশিয়ায় বেইজিং-এর কর্মকাণ্ড নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে ভারত। বাংলাদেশ ও নেপালে চীনের টিকা দেয়ার প্রস্তাবের বিপরীতে ভারত নিজেও টিকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু কিছু দেশ আছে যাদের চীন ছাড়া বিকল্প খুব কমই। ইন্দোনেশিয়া ইতিমধ্যেই সিনোভ্যাকের জন্য ১৬২০ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই ৫ কোটি ডোজের জন্য চীনের সঙ্গে চুক্তিও করেছে দেশটি। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত টিকা উৎপাদক প্রতিষ্ঠান পিটি বায়ো ফার্মাও এই টিকা উৎপাদন করতে পারবে। ইন্দোনেশিয়ার কিছু রাজনীতি বিশেষজ্ঞ চিন্তিত যে, এসব কারণে ইন্দোনেশিয়ায় চীনের প্রভাব অনেক বাড়বে। কিন্তু তারা এ-ও স্বীকার করেছেন যে, ইন্দোনেশিয়ার তেমন বিকল্পও নেই। ইউনিভার্সিটি অব ইসলাম ইন্দোনেশিয়ায় চীনের পররাষ্ট্রনীতি গবেষণা করেন মুহাম্মদ জুলফিকার রখমত। তিনি বলেন, ‘আমাদের কি সন্দিগ্ধ হওয়া উচিত নাকি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত? আমার মনে হয় দু’টোই হওয়া উচিত।’
(সুই-লি উই নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেইজিং ব্যুরোতে কাজ করেন। তার প্রতিবেদনটি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত।)