শনাক্তের হার কমছে : হার্ড ইমিউনিটি কতোটা এসেছে?

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সরকারি হিসাবে দেশে করোনা সংক্রমণ এখন কমতির দিকে। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার কমছে। যদিও মৃত্যুর পরিসংখ্যান এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়েই আছে। এমন অবস্থায় হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। শুরু থেকেই বলা হচ্ছিল হার্ড ইমিউনিটি অর্জন হলে একপর্যায়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তবে এই চিন্তায় বড় বিপত্তি হয়ে এসেছে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ। অনেকে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পর আবারো আক্রান্ত হচ্ছেন। এতে চিন্তিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন- এমন অবস্থায় হার্ড ইমিউনিটির চিন্তা অমূলক। কারণ দেশে এখন পর্যন্ত করোনার নমুনা পরীক্ষাই সন্তোষজনক অবস্থায় নেই। তাই প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা জানা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের বিষয়টি কিভাবে বিবেচ্য হবে। এ ছাড়া এ নিয়ে পৃথক কোনো গবেষণাও নেই। তাই হার্ড ইমিউনিটি অর্জন হয়ে গেছে বা হবে এমনটি ভাবাও ঠিক হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
করোনা প্রতিরোধে বাংলাদেশে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হওয়াকে কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক মানবজমিনকে বলেন, আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষের মধ্যে যদি করোনা সংক্রমিত হয়ে যায় তাহলে দেশের অধিকাংশের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হয়ে যায়। এ হিসাবে বাংলাদেশে কমপক্ষে ১২ কোটি লোকের করোনা সংক্রমণ হতে হবে। সুতরাং হার্ড ইমিউনিটি হওয়া এটা চিন্তা করাই বোকামি। এটা অসম্ভব। যদি হয় তাহলে লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে। ১২ কোটি লোকের করোনা সংক্রমণ হলে আমাদের যে স্বাস্থ্যসেবা আছে তা দিয়ে ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব নয়। কী কৌশলে করোনার বর্তমান অবস্থা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা নিয়ে সরকার এবং বিশেষজ্ঞদের চিন্তা করা উচিত বলে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মনে করেন। তিনি বলেন, সঠিক পরিকল্পনা করে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ বিষয়ে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য, দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, দেশে মানুষের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে এটা বলার কোনো গবেষণা হয়নি। অ্যান্টিবডি টেস্ট হয়নি। জরিপে বস্তিতে কম সংক্রমণ হয়েছে সেই প্রসঙ্গ টেনে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, বস্তিতে হয়তো অন্যান্য ভাইরাস রয়েছে, এজন্য করোনাভাইরাসটি সেখানে কম সংক্রমিত হয়েছে। এটা একটা সম্ভাবনা। হার্ড ইমিউনিটি বলতে হলে অবশ্যই গবেষণা লাগবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ড. পুনম ক্ষেত্রপাল সিং বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে বলেছেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে ডব্লিউএইচও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে। এর মধ্যে ভাইরাসে মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি নথিবদ্ধ করার কাজও অন্তর্ভুক্ত আছে। এখানে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে এটি বলার মতো প্রাসঙ্গিক তথ্যসহ কোনো প্রযুক্তিগত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে গোষ্ঠী সংক্রমণ পর্যায়ে রয়েছে। যার অর্থ হলো ভাইরাসটি এমনভাবে ছড়াচ্ছে যে সব ক্ষেত্রে সংক্রমণের উৎস জানা সম্ভব হচ্ছে না। এরপরও বাংলাদেশ সরকারের সমন্বয়, আগেভাগে রোগ শনাক্তকরণ, স্বাস্থ্যগত ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপ সুফল দিয়েছে। এসব পদক্ষেপ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার হার এবং চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন এমন নতুন সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা এমনভাবে সীমিত রাখতে সহায়ক হয়েছে যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপ অনেক বেশি বেড়ে যায়নি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ কী কী পদক্ষেপ নিতে পারে? এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের উচিত হবে রোগ প্রতিরোধে স্থানীয় পর্যায়ে যে মিশ্র পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা চালু রাখা। একইসঙ্গে কোভিড-১৯ রোগে যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সুবিধা সরবরাহের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু কড়াকড়ি তুলে দেয়া হচ্ছে, সেহেতু মানুষের এটি বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে ভাইরাস এখনো স্থানীয় পর্যায়ে কার্যকর আছে। এ কারণে পর্যাপ্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং এর নিয়মিত পর্যালোচনা জারি রাখা প্রয়োজন। যেমন মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও নিয়মিত হাত ধোয়ার বিষয়গুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকা দরকার।
এদিকে, গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত করোনাভাইরাস বিষয়ক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরো ৩১ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ালো ৪ হাজার ৭৩৩ জনে। একই সময়ে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১ হাজার ৪৭৬ জন। মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৫২০ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ২ হাজার ৩৭২ জন। এ নিয়ে মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ২ লাখ ৪০ হাজার ৬৪৩ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৯৪টি করোনা পরীক্ষাগারে ১২ হাজার ৮৫০টি নমুনা সংগ্রহ হয়। পরীক্ষা হয়েছে ১২ হাজার ৯৯৯টি। এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৭ লাখ ২৮ হাজার ৪৮০টি। ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। রোগী শনাক্তের বিবেচনায় সুস্থতার হার ৭১ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার এক দশমিক ৪০ শতাংশ। একদিনে মারা যাওয়াদের মধ্যে পুরুষ ২৫ জন এবং নারী ৬ জন। হাসপাতালে ২৮ জন এবং বাসায় ৩ জ?নের মৃত্যু হয়। এ পর্যন্ত করোনায় মোট মৃতের মধ্যে পুরুষ ৩ হাজার ৬৮৬ (৭৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ) এবং নারী ১ হাজার ৪৭ জন (২২ দশমিক শূন্য ১২ শতাংশ)। বিভাগ অনুযায়ী- ৩১ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৮ জন, চট্টগ্রামে ৫ জন, রাজশাহীতে ২ জন, খুলনায় ১ জন, সিলেটে ২ জন, রংপুরে ২ জন এবং ময়মন?সিং?হে ১ জন রয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) বরাত দিয়ে আরো জানানো হয়, এক সপ্তাহে শনাক্তের হার কমলেও মৃত্যু বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে (৬-১২ই সেপ্টেম্বর বা ৩৭তম সপ্তাহ) রাজধানীসহ সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি আরটি-পিসিআর ল্যাবরেটরিতে মোট ৯৭ হাজার ৫২৩ জনের করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ সময়ে নমুনা পরীক্ষায় ১২ হাজার ৪৭৯ জন নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। একই সময়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে হাসপাতাল ও বাসায় চিকিৎসা গ্রহণ করে ২০ হাজার ৪১৯ জন সুস্থ হয়ে ওঠেন। এই সময়ে করোনা আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ২৫৫ জনের মৃত্যু হয়। পূর্ববর্তী এক সপ্তাহের (৩৬তম) তুলনায় নমুনা পরীক্ষা ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ হ্রাস পায়। একই সময়ে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে সুস্থতার হার ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। শনাক্তের হার কমলেও ৩৬তম সপ্তাহের তুলনায় ৩৭তম সপ্তাহে মৃত্যুর হার ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।