যশোর মেডিকেলে নমুনা পরীক্ষার তোড়জোড়

0

স্টাফ রিপোর্টার॥ সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের নমুনা পরীক্ষার কাজ যশোর মেডিকেল কলেজে (যমেক) শুরু করার তোড়জোড় চলছে। চলতি সপ্তাহেই এই কাজ শুরুর অনুমোদন পাওয়া যাবে বলে কর্তৃপ আশাবাদী। তাদের ভাষ্য, এই মেডিকেল কলেজে রয়েছে দ জনবল। প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যমান ল্যাবরেটরিতে পিসিআর মেশিন, বায়োসেফটি কেবিনেট আর আনুষঙ্গিক কিছু যন্ত্রপাতি হলেই এখানে করোনা পরীা করা সম্ভব। এর আগে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোম সেন্টারে নমুনা পরীা শুরু হয় গত মাসে। এর পর থেকেই স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির ‘টাগ অব ওয়ার’ নিয়ে বাতাসে নানা কথাবার্তা ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে দুই প্রতিষ্ঠানের কর্তারাই এইসব কথাবার্তা উড়িয়ে দিয়ে নতুন উদ্যোগকে পজিটিভলি দেখছেন বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. আনোয়ার হোসেন তার প্রতিষ্ঠানের জেনোম সেন্টারে সন্দেহভাজন রোগীদের নমুনা পরীা করা সম্ভব বলে জানিয়েছিলেন। শুধু বলেই থেমেই ছিলেন না দেশের অন্যতম শীর্ষ এই অণুজীববিজ্ঞানী। দেশের স্বার্থে এই কাজ যাতে যবিপ্রবিতে করা যায়, ঝুঁকি থাকলেও সে চেষ্টাও তিনি করতে থাকেন। ফলও পাওয়া যায়। গত ১২ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপ যবিপ্রবি জেনোম সেন্টারে নমুনা পরীার অনুমতি দেয়। এরপর দরকারি প্রস্তুতি শেষ করে ১৭ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়টি নমুনা পরীার কাজ শুরু করে। যবিবিতে সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের শরীরের নমুনা পরীার কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যশোর স্বাস্থ্য বিভাগের সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয় বলে খবর রটতে থাকে। যদিও দুই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে এসবের সত্যতা স্বীকার করেননি। এরই মধ্যে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারাসহ মেডিকেল কলেজ কর্তৃপ তাদের ল্যাবে করোনা পরীার অনুমতি পেতে তৎপরতা শুরু করেন। সেই তৎপরতা এখন ফলবতী হতে চলেছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
যশোর মেডিকেল কলেজের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ২০১০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জেনারেল হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটের দোতলায় সংকীর্ণ স্থানে শুরু হয়। সেখানে টানা সাত বছর কার্যক্রম পরিচালনার পর ২০১৭ সালের জুনে কলেজটি শহরতলীর শঙ্করপুরের পাশে হরিণার বিলে নিজস্ব ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে দশ তলা ভিতের একটি ভবনের ছয় তলা পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়েছে। ওই ভবনের ষষ্ঠ তলায় কলেজটির ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠিত। এই ল্যাবটিকে ‘অত্যাধুনিক’ হিসেবে বর্ণনা করে গেল শুক্রবার রাতে কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্য প্রফেসর ডা. মো. গিয়াস উদ্দীন বলেছিলেন, পলিমার চেইন রি-অ্যাকশন (পিসিআর) মেশিনসহ আনুষঙ্গিক কিছু জিনিসপত্র পেলে এখানে করোনা পরীা করা সম্ভব। এগুলো পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অধ্য সেদিন নিশ্চিতও করেছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যশোর অঞ্চলের সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের নমুনা পরীা করার জন্য দ্রুত একটি ডেডিকেটেড ল্যাব স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে যমেক কর্তৃপ জোর চেষ্টা চালাতে থাকেন। কলেজ অধ্য গত ১৯ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা, শিা, স্বাস্থ্য ও জনশক্তি উন্নয়ন শাখার লাইন ডিরেক্টরের কাছে এখানে একটি ডেটিকেটেড ল্যাবসহ পিসিআর মেশিন স্থাপনের জন্য আবেদন করেন। যার স্মারক নম্বর যমেক/প্রশাসন/২০২০/৩০০। আবেদনে বলা হয়, যশোর মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন বিভাগের (প্যাথলজি, মাইক্রোবায়োলজি এবং বায়োকেমিস্ট্রি) জন্য অত্যাধুনিক ল্যাব চালু আছে। পিসিআর মেশিন স্থাপন করার জন্য আছে পর্যাপ্ত জায়গাও। এছাড়া একজন সহযোগী অধ্যাপক, দুইজন সহকারী অধ্যাপক এবং তিনজন প্রভাষকসহ বিএসসি ডিগ্রিধারী ছয়জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) কর্মরত আছেন। যেখানে করোনাসহ (কেভিড-১৯) বিভিন্ন ভাইরাস পরীা-নিরীা করা যাবে যাবে। এ জন্য কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে পিসিআর মেশিন, বায়োসেফটি কেবিনেটসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে একটি ডেটিকেটেড ল্যাব স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। এই তৎপরতার আপডেট জানার জন্য শনি ও রোববার দফায় দফায় যমেক অধ্য ডা. গিয়াসের নাম্বারে ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে মেডিকেল কলেজের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান রোববার রাতে জানিয়েছেন, এখন শুধু অনুমতির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকি। অনুমতির সঙ্গে পিসিআর মেশিন ও বায়োসেফটি কেবিনেট প্রাপ্তিসাপেে নমুনা পরীার কাজ শুরু করে দেওয়া যাবে। কলেজের ল্যাবও পরিচ্ছন্ন রয়েছে। আরিফুজ্জামান বলেন, ‘মন্ত্রণালয় যশোর মেডিকেল কলেজের আবেদন পরীা-নিরীা করেছে। তাদের সমস্ত ধরনের কোয়ারির জবাব দেওয়া হয়েছে। আজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (শিা) সঙ্গে কথা বলেছেন অধ্য। মন্ত্রণালয়ের ফিডব্যাক পেলেই তা যশোরে জানিয়ে দেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোনো মেডিকেল কলেজ যদি নমুনা পরীার সুযোগ পায়, তাহলে প্রথমেই পাওয়া উচিত যশোরের। দ্বিতীয় সাতীরা। তার কথায়, ‘এই দুই মেডিকেল কলেজের মতো সুইটেবল প্লেস আর নেই। কিন্তু সাতীরা মেডিকেলে দ জনবল সংকট আছে। আর যশোর মেডিকেলে পর্যাপ্ত জনবল রয়েছে। এখানে চারজন ফুল প্রফেসর, ১৩ জন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরসহ ১১৬ জন শিক রয়েছেন।’
করোনাভাইরাস অতিসংক্রামক হওয়ায় কোনো ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা আছে কি-না জানতে চাইলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান বলেন, তেমন কোনো আশঙ্কা নেই। এখানে এই ধরনের কাজ যে নতুন করে করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। এই মেডিকেল কলেজের ল্যাবে ইতিমধ্যে ক্যানসার শনাক্তের জন্য বায়োপসি, হিস্টো কেমিস্টসহ নানা ধরনের পরীার কাজ চলছে। পিসিআরের চেয়ে দামি দামি মেশিনপত্রও রয়েছে। এখনো পর্যন্ত নিরাপত্তাজনিত কোনো সমস্যা হয়নি। ‘সরকার যদি এখন না-ও দেয়, তো আগামী জুনের মধ্যে আমরাই পিসিআর মেশিন কিনে নেবো। বায়োসেফটি কেবিনেট বসানোর পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কাজ শুরু করতে পারবো,’ দৃঢ়তার সঙ্গে বলছিলেন আরিফুজ্জামান।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে টেক্কা দিতেই কি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপ পিসিআর মেশিন আনার উদ্যোগ নিয়েছে?- এমন প্রশ্নে গেল শুক্রবার যমেক অধ্য প্রফেসর ডা. মো. গিয়াস উদ্দীন বলেছিলেন, ‘ব্যাপারটা তা নয়। দুই প্রতিষ্ঠানই কাজ করবে। এতে একটা কম্পিটিটিভ অবস্থা তৈরি হবে। ফলে যশোরাঞ্চলের মানুষ আরো বেশি উপকৃত হবে।’ যমেক-এর প্রশাসনিক কর্মকর্তাও একই সুরে বলেন, দুটি ল্যাবে কাজ হলে তো এই অঞ্চলের মানুষই উপকৃত হবে। এতে শত্র“তার তো কিছু নেই। তিনি উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ারকে ‘অত্যন্ত উঁচুমানের অণুজীববিজ্ঞানী’ মন্তব্য করে বলেন, নিজে গবেষক হওয়ায় তার আন্তরিকতার অভাব নেই। যবিপ্রবির ল্যাবও অত্যাধুনিক।
যবিপ্রবি উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেনও যশোর মেডিকেল কলেজের ল্যাবে নমুনা পরীার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত দ জনবল থাকলে অবশ্যই তারা (যমেক) পরীা করতে পারবে। তবে এটি সময়সাপে। আর অবশ্যই বায়োসেফটির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও চলমান নমুনা পরীা কার্যক্রমের প্রথম টিমের লিডার ড. ইকবাল কবীর জাহিদ গতকাল দুপুরে বলেন, যার যতটুকু সুযোগ আছে, তিনি দেশের জন্য সেভাবেই কাজ করবেন। ওই সময় পিসিআর মেশিন ও ভাইরাস নিয়ে কাজ করার েেত্র সতর্কতার বিষয়টি তুলে ধরেন এই শিক। এই অঞ্চলের একটি মেডিকেল কলেজ ল্যাবের কিছু পরীার ফলাফল বিভ্রাটের প্রসঙ্গ তুলে ধরে ড. জাহিদ বলেন, ল্যাব জীবাণুমুক্ত করার কাজটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সঠিকভাবে এই কাজটি করতে না পারলে এবং ভাইরাস সংক্রান্ত পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকলে সঠিক ফলাফল বের করা সম্ভব নাও হতে পারে।